রাজধানীর আদাবর থানাধীন মেহেদীবাগ এলাকায় এক তরুণীকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এক পর্যায়ে মেয়েটিকে প্রকাশ্যে মারধর করে তারা। এমনকি তরুণীর অভিভাবককে হত্যার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। পরিবারের আতঙ্কিত সদস্যরা কিছুদিন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। পরে পুলিশের নিরাপত্তার আশ্বাসে তারা ফিরে আসে। এরপর ওই কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। তবে এখনো কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ার পরিবারটি আতঙ্কে রয়েছে। এ ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার আদাবর থানার ওসি এস এম জাকারিয়া বলেন, ওই পরিবারের নিরাপত্তার দেখভাল করছে পুলিশ। এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ আসছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।ওই এলাকায় গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদাবর এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। সব মিলিয়ে সদস্য এক হাজারের বেশি। শুধু আদাবরই নয়, রাজধানীর অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দৌরাত্ম্য রয়েছে, যা এলাকাবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে।
ঢাকার বাইরে অনেক জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত এলাকায়ও এমন কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রবের তথ্য দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখের টেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে দেশের সর্বত্র কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বেড়েছে। হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধী হিসেবে তারা কাজ করছে। প্রতিদিনই এদের আটক করা হচ্ছে। তবে জামিন নিয়ে ফের তারা একই কাজ করছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এসব কিশোর-তরুণ পাড়া-মহল্লারই উঠতি বয়সী বখাটে ছেলে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কিশোর গ্যাংয়ের নতুন তালিকা করে অভিযান চালাতে সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরে গত পাঁচ মাসে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের নিয়ন্ত্রণের পথ খোঁজা হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপারদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলে সদস্যসংখ্যা বেড়ে ২০ হাজারের বেশি হয়েছে। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে।
সদর দপ্তর সূত্র বলছে, শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য আরো বেড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ বলছে, মাদক, বাড়তি টাকার লোভ, আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেকে বড় ভাবার প্রবণতা, বেকারত্ব, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাসহ আরো বেশ কয়েকটি কারণে তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, বর্তমানে সামাজিক অপরাধের মূলে রয়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাদের অপরাধের সূতিকাগার বললেও ভুল হবে না। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রেপ্তার করতে তৎপর রয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি গ্রুপ রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের আগে ঢাকায় এসব গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৮২। বর্তমানে তা বেড়েছে। এখন ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে এক হাজার সদস্য রয়েছে। চট্টগ্রামে ৫৭টি গ্রুপে ৩১৬ সদস্য রয়েছে। পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে ৭৮০টি মামলা হয়। প্রতিটি মামলায় তাদের আসামি করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, পুলিশের মাসিক ক্রাইম করফারেন্সেও কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কী কী করণীয়, তা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। এরই মধ্যে গত পাঁচ মাসে সারা দেশে প্রায় এক হাজার কিশোর-তরুণ অপরাধীচক্রের সদস্য আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো এই অপরাধীচক্রের কয়েক হাজার সদস্য নজরদারিতে রয়েছে। তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিনিয়ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ বলছে, শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীই নয়, এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে পরিবারের মা-বাবাসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। এ ছাড়া অভিভাবকদের সঙ্গেও তাঁরা নিয়মিত কথা বলছেন। থানা করিডরে তাঁদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত উঠান বৈঠক করা হয়।
সাম্প্রতিক অপরাধ : গত ৬ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আদাবর ১৬ নম্বর রোডের একটি বাসায় লকার ভেঙে ৪৫ ভরি সোনা লুটের ঘটনায় দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জড়িত আরো অনেক কিশোর-তরুণ এখনো আটক হয়নি। গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় এক পথশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রায়হান নামের এক তরুণকে আটক করে পুলিশ। গত ২১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে রিকশাচালক জিন্নাহ (৬০) গেণ্ডারিয়ার জুরাইনের একটি গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে ভাড়ার উদ্দেশ্যে বের হন। পোস্তগোলা থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের দুই যাত্রীকে নিয়ে সেদিন রাত ৩টার দিকে গেণ্ডারিয়া থানার আঞ্জুমান কবরস্থানের সামনে পৌঁছলে ওই দুই যাত্রী পেছন থেকে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। রিকশাচালকের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে অজ্ঞাতপরিচয় ওই দুই যাত্রী পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর জিন্নাহ মারা যান। এ বিষয়ে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে কিশোর গ্যাং জড়িত। কিশোর ও তরুণ বয়সী জালাল সরদার, ফজলে রাব্বি ও ইমরান নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে এ তথ্য পাওয়া যায়। এরা আগেও কয়েকজনকে হত্যা করে।