গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমেছে। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ইলিশ উৎপাদন ছয় বছরের মধ্যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নেপথ্যের কারণগুলোর মধ্যে অবাধে জাটকা নিধন ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার ও বৃষ্টিপাতের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ইলিশের উৎপাদন কমায় গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বরিশাল বেলস পার্কে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলছেন, ‘জাটকা নিধন বন্ধ হলে এবং উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও ইলিশ রপ্তানি করা সম্ভব। তাই জাটকা সংরক্ষণের জন্য আমরা ক্ষতিকর জাল তৈরি করে এমন সব কারখানা বন্ধ করার কার্যক্রম চলমান রেখেছি। ইলিশের বাড়ি ভোলা আর বিভাগ বরিশাল। কেননা দেশে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৬ শতাংশ বরিশাল বিভাগে উৎপাদিত হয়।
উৎপাদন কমেছে
মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, ২০২৩-২০২৪ সালে ৫ দশমিক ২৯ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ সারা দেশে আহরিত হয়েছে, যা বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪২ হাজার মেট্রিক টন কম। অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টন ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২১-২২ সালে ৫ দশমিক ৬৬ লাখ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ সালে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ দশমিক ৩২ লাখ মেট্রিক টন। অর্থ বছরগুলোর উৎপাদন পর্যালোচনা করলে ইলিশ উৎপাদন ছয় বছরের মধ্যে এবারই তলানিতে নেমে এসেছে, তা পরিলক্ষিত হবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। চার বছরে বার্ষিক উৎপাদন ছয় লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। টানা চার অর্থবছরে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম। কিন্তু ২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আরো কমে গিয়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাড়ছে দূষণ, কমছে উৎপাদন
মেঘনা, পায়রা, তেঁতুলিয়া নদী আর আন্ধারমানিক নদ এ অঞ্চলের ইলিশের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।
সেখানেও পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ।
বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে ইলিশ উৎপাদনের ওপর একসময় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যে নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ দূষণ।
কলাপাড়া ও তালতলীর পায়রা নদীর তীরেই তিনটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে। অপর একটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। পায়রা নদীই হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পানির জোগানদাতা। কেন্দ্রগুলো থেকে নির্গত গরম পানি ও বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে পায়রায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল আনতে সমুদ্রবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেল খনন করা হয়েছে। ফলে পায়রাপথে জাহাজ চলাচল বাড়ছে। এতে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ইলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রবেশপথ পায়রায় আটকে যাচ্ছে।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলন, বিচরণ ও পালনকেন্দ্র হচ্ছে কলাপাড়া-কুয়াকাটা। জাটকা থেকে ইলিশে পরিণত হওয়ার আগে ইলিশের দল বসত গড়ে পায়রার অদূরে আন্ধারমানিক নদের বুকে। এই নদে ইলিশ একটু পরিণত হয়ে দল বেঁধে বঙ্গোপসাগরের দিকে ফিরে যায়। একটা সময় এই নদে দূষণ ছিল না, তখন আন্ধারমানিকে ইলিশের খাবারের জোগানও বেশি ছিল। কিন্তু পায়রায় উন্নয়নমূলক কাজ চলমান থাকায় ইলিশের বিচারণক্ষেত্রে যাতায়াত কমেছে।
ইলিশ কমার কারণ
চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু কাওসার দিদার বলেন, ‘ইলিশ মাছের প্রধান মাইগ্রেশন এলাকা মেঘনা, তেঁতুলিয়া, পায়রা, বিষখালীতে নাব্যতার সংকট দেখা দিয়েছে। ইলিশ মাছের জন্য পাঁচ মিটারের বেশি গভীরতা আদর্শ হলেও, এই নৌপথগুলোতে কোথাও কোথাও দুই থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানি রয়েছে। এ ছাড়াও ইলিশের মাইগ্রেশন পথে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ আহরণ করতে থাকায় ইলিশের উৎপাদন কমছে।’
মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ প্রকল্পের সাবেক গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক হারে অবৈধ জালের ব্যবহার মৎস্য সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। উপকূলীয় এলাকায় ট্রলিং জাহাজ ৪০ মিটারের কম গভীরতায়ও মাছ আহরণ করছে, যা ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদনে নতুন করে শঙ্কার সৃষ্টি করছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি অভয়াশ্রমে উন্নয়ন প্রকল্প ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অফিসের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, ‘গত বছর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে, জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারেননি। ফলে মাছের আহরণ কমেছিল।’
জাটকা নিধনের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘জাটকা সংরক্ষণে প্রচেষ্টা চালালেও লাখ লাখ জেলে অবৈধভাবে জাটকা শিকার করছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান করা হলেও শত শত কিলোমিটার নদী ও মোহনা পাহারা দেওয়া দুঃসাধ্য বিষয়।’