মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্বকাকৈর এলাকার, পল্লী চিকিৎসক মোঃ হুমায়ুন কবির খানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে আহত মোঃ সাহাদাত হোসেন খান মিশন। ঢাকায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করতেন তিনি।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে চলেন তিনি। ক্রাচে ভর না দিলে চলতে পারেনা।
খুব দরকার না হলে বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হন না । কখনো ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির আঙিনায়,আবার কখনো পাশের রাস্তায় হেঁটে বেড়ান আহত জুলাইযোদ্ধা মোঃ সাহাদাত হোসেন খান মিশন।
১৯ শে জুলাই সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেন। প্রথম দিনেই রাবার বুলেটে আহত হন । এরপর ৪ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় গুলির আঘাতে ভেঙ্গে যায় অপর পা । দীর্ঘ ১০ মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বাড়ি ফিরেছেন তিনি । তবে আর কাজ করা সম্ভব হয়নি। থমকে গেছে তার স্বাভাবিক জীবন। থেমে গেছে উপার্জনের চাকাও । এখন দিন কাটছে বাড়ি, নিজ ঘরে । অপেক্ষা, পরিপূর্ণ সুস্থতা হওয়ার। সরকার যেন তার মতো অসংখ্য আহত জুলাইযোদ্ধাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে, শীঘ্রই এমনটাই তার দাবি।
অপেক্ষা, কবে সুস্থ হবেন, হাঁটতে পারবেন স্বাভাবিক গতিতে । নাকি কখনোই আর স্বাভাবিক হতে পারবেন না । এ প্রশ্ন এখন মাদারীপুর জেলার শিবচরের জুলাইযোদ্ধা আহত মোঃ শাহাদাত হোসেন খান মিশন এর চোখে মুখে এখন অন্ধকার।
সরেজমিনে আহত মোঃ সাহাদাত হোসেন খান মিশনের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন তিনি। সারাক্ষন ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভালো না লাগায় মাঝে মধ্যেই বাড়ির বাইরে বের হন বলে জানান তিনি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আহত মোঃ শাহাদাত হোসেন খান মিশন বলেন, ১৮ জুলাই কাজের জন্য আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। ঢাকার অবস্থা ফেসবুকে দেখি । তখন ও ইন্টারনেট ছিল। আন্দোলন শুরু থেকেই আমি স্বৈরাচারের হটানোর পক্ষে ছিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করতাম স্বৈরাচারের অবসান হোক এ দেশে। এরপর আন্দোলন যখন বেগবান হচ্ছে, তখন তার নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । ওই রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই । ১৯ জুলাই, ঢাকায় ফিরে সরাসরি আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দেই । তখন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাই। ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যাই আন্দোলনে। তুমুল আন্দোলন, ধাওয়া-পাল্টা, ধাওয়া চলছে । তাদের সঙ্গে রামপুরার দিকে যখন যাই, তখনই পুলিশের গুলি বর্ষণ রাবার বুলেট লাগে ডান পায়ে । বাসায় ফিরে যাই ওই অবস্থায় । চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে কাজ শুরু করি । কাজ শেষে আন্দোলনে যাই, খোঁজখবর রাখি নিয়মিত ।
তিনি বলেন, এরপর ৪ আগস্ট আন্দোলন যখন তুমুল পর্যায়ে । তখন বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দেই আন্দোলনে । প্রথম শাহাবাগ পিজি হাসপাতালের ওখানে যাই। তখন হাসপাতালে আগুন জ্বলছিল । সেখান থেকে আমরা বিকেল পাঁচটার দিকে তেজগাঁও কাওরান বাজারের মাঝামাঝি স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছিলাম । স্বৈরাচার হটানোর স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ তখন উত্তাল । মনে হচ্ছে জয়ের দ্বারপ্রান্তে আমরা। ওই মুহূর্তে আন্দোলনকারিদের ওপর পুলিশ - বিজিবির গুলিবর্ষণ শুরু হয় । ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে । এরই মধ্যে পরপর দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় বাম পায়ে । মুহূর্তেই ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায় বাম পা।সেই থেকে দশ মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। কাজ করতে পারি না। জুলাই ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সহ সরকারি বেসরকারি অনুদান পেয়েছি। কিন্তু আমাদের মতো আহতদের স্থায়ী কর্মসংস্থান দরকার। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। যাতে করে আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
জুলাইযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন খান মিশন।
আহত মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন খান মিশন এর বাবা মোঃ হুমায়ুন কবির খান বলেন, ৪ আগস্ট বিকেলে ওর গুলি লাগার ২-৩ মিনিট আগে আমি ফোন দিয়ে ছেলেকে । আমার ছেলে বলে বাবা আমার লাশ খুঁজতে আইসেন না। আমার জীবন আমি দিয়ে দিবো, তবুও রাজপথ ছাড়বো না। আমার ছেলে পরিবারের ভরণপোষণের একজন ছিল। আজ গুলি লেগে পঙ্গু হয়ে আছে। আমার ছেলের জন্য সরকার কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিক এমনটাই একমাত্র চাওয়া।
টগবগে তরুণের দুই বাহুর নিচে ক্রাচ। তাতে ভর দিয়ে হেঁটে বাড়ির বাইরে এলেন দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ ও শিবচর প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন মোল্লাকে বিদায় জানাতে।
দুই চোখে পানিতে টলটল করছে।