ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক ডজনেরও বেশি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। পাল্টা জবাবে ইরানি সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই হামলায় নিহত হয়েছেন আরও একজন পরমাণু বিজ্ঞানী, যার ফলে ইসরায়েলি হামলায় ইরানে সরকারি মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ জনে।
এরই মধ্যে আমেরিকার সরাসরি হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনার ফলে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এক নতুন মোড় নিচ্ছে, যা শুধুই আঞ্চলিক সংঘর্ষে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রশ্ন উঠছে—এ কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস, নাকি এক দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সংঘাত?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে ইরান হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জল্পনা ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ইরানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যেই এই প্রস্তাবে মৌখিক সমর্থন জানালেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ।
হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি পরিবহণ জলপথ। ওমান ও ইরানের মধ্যবর্তী এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়েই বিশ্বের প্রায় ২০% তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও ৫ ভাগের ১ ভাগ অপরিশোধিত তেল আমদানি-রফতানি হয়। সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও ইরানের মতো ওপেক দেশগুলি এই পথেই তেল ও গ্যাস রফতানি করে।
এই অবস্থায় প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে গোটা বিশ্বের জ্বালানি বাজারে ব্যাপক ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ও চিনকে বার্তা:
এই পরিস্থিতিতে চিনকে সরাসরি বার্তা দিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিও বলেছেন, “চিনের উচিত ইরানের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করা। কারণ চিন নিজেও তাদের জ্বালানি সরবরাহের জন্য হরমুজ় প্রণালীর উপর নির্ভরশীল।”
রুবিও আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “প্রণালী বন্ধ করা ইরানের জন্য হবে একটি অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে, তবে সবথেকে বড় ক্ষতি হবে ইরানের নিজের।”
চিন ও রাশিয়ার কড়া প্রতিক্রিয়া:
তবে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে চিন ও রাশিয়া। বেজিং জানিয়েছে, আমেরিকা রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের তোয়াক্কা না করেই ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে আঘাত হেনেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সমান।
রাশিয়ার পক্ষ থেকেও এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই হামলা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়, বরং আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।” রুশ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের কথায়, “ইরানকে পরমাণু অস্ত্র দেওয়ার জন্য অনেক দেশ প্রস্তুত।”
ভারতের অবস্থান:
এই উত্তেজনার মাঝেও ভারত তুলনামূলক ভাবে স্থির। নয়াদিল্লি জানিয়েছে, ভারতের তেলের বড় অংশ এখন হরমুজ় প্রণালী হয়ে আসে না। পাশাপাশি দেশে পর্যাপ্ত মজুত ও বিকল্প জ্বালানি আমদানি পথ তৈরি রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী। ফলে আপাতত ভারতের পক্ষ থেকে আতঙ্কের কোনও কারণ নেই।
জাতিসংঘের ভূমিকা:
জাতিসংঘ এখনও পর্যন্ত ইরানের ওপর মার্কিন হামলা বিষয়ে সরাসরি কোনও অবস্থান নেয়নি। তবে আন্তর্জাতিক মহলে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠছে—জাতিসংঘ কি আমেরিকার এই একতরফা সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
পশ্চিম এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এক নতুন সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। হরমুজ় প্রণালী বন্ধ হলে শুধু অঞ্চল নয়, পুরো বিশ্বের জ্বালানি ও অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতা সময়ের দাবি, নইলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
🔻 বিশ্লেষণ: কে লাভবান, কে ক্ষতিগ্রস্ত?
ইরান ও ইসরায়েল: প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষে উভয় দেশই প্রাণ ও সম্পদের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা: মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা চরমভাবে বিঘ্নিত, হরমুজ প্রণালী ঘিরে নতুন করে অনিশ্চয়তা।
বিশ্ব অর্থনীতি: তেলের দাম অস্থির, সরবরাহ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত—বিশেষত ইউরোপ ও এশিয়ার তেল-নির্ভর দেশগুলিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
🟢 সম্ভাব্য লাভবান:
অস্ত্র ব্যবসায়ী ও প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্ত্র রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি।
বিকল্প জ্বালানির বাজার: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আগ্রহ বাড়তে পারে, বিশেষত ইউরোপ ও চীন ইতিমধ্যেই বিকল্প খুঁজছে।
কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র: ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে হস্তক্ষেপ করে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে, অনেক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এ মুহূর্তে এটি সরাসরি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিচ্ছে না, তবে ‘ছায়াযুদ্ধ’ বা ‘প্রক্সি ও বাণিজ্যিক যুদ্ধের’ দিকেই এগোচ্ছে। সংঘর্ষ না থামলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়বে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বর্তমানে একটি সীমিত আকারের হলেও, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়ায় এটি একটি বহুমাত্রিক সংঘর্ষে রূপ নিতে চলেছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এখনই না হলে, বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।