ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আবারও পাঁচটি সীমান্তবর্তী জেলা—পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, মৌলভীবাজার, ফেনী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি দিয়ে মোট ১০৪ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করল। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতরাত থেকে এ পর্যন্ত মোট ১০৪ জন বাংলাদেশে এসেছেন।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) ভোরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার জয়ধরভাঙ্গা বড়বাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর ২১ জনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর মধ্যে ১৪ শিশু রয়েছে, যাদের বয়স তিন মাস থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এছাড়া, ২২ বছর বয়সী এক যুবক এবং ছয়জন নারী, যারা ১৯ থেকে ৫৫ বছর বয়সী। তাদের বাড়ি খুলনা ও নড়াইল জেলায়।
বিজিবি নীলফামারী ৫৬ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেন, 'জয়ধরভাঙ্গা বর্ডার আউটপোস্টের (বিওপি) সদস্যরা ৭৭৫/১০-এস পিলারের কাছ থেকে ২১ জনকে আটক করেছেন।' তিনি আরও বলেন, 'আটক ব্যক্তিরা দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের গুজরাট রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছেন। ভারতীয় পুলিশ আটকের পর তাদের বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে, পরবর্তীতে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।'
তবে বিজিবির আহ্বানে পতাকা বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএসএফ দাবি করে—এই ঘটনায় তাদের কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা নেই। এরপর বিজিবির পক্ষ থেকে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক আহ্বান করা হয়। সীমান্তের শূন্য রেখায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে প্রোটোকল না মানায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
এর আগে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় সীমান্ত দিয়ে একইভাবে আরও ২৮ জনকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল ভারত। পঞ্চগড় থানার পরিদর্শক এইচএসএম সোহরাওয়ার্দী নিশ্চিত করেছেন, এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের হচ্ছে।
এছাড়া, গত রাতে পাটগ্রাম উপজেলার ধবলসুটি ও ঝালাঙ্গী সীমান্ত দিয়ে ১১ নারী, দুইজন পুরুষ ও সাত শিশুসহ মোট ২০ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বিজিবি ৬১ ব্যাটালিয়নের ধবলসুটি বিওপি (বর্ডার আউটপোস্ট) ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার আব্দুল মতিন বলেন, 'আমরা তাদের উদ্ধার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিলাম। পরে তাদের পাটগ্রাম থানায় হস্তান্তর করা হয়।'
'প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাতের অন্ধকারে বিএসএফ তাদের জোর করে ঠেলে দিয়েছে,' বলেন তিনি।
পটাগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, '২০ জনের পরিচয়, ঠিকানা ও ফিরে আসার কারণ যাচাই করা হচ্ছে। আমাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
গতকাল কুলাউড়া উপজেলার মুরইছড়া সীমান্ত দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার সাতজন—দুইজন পুরুষ, দুইজন নারী ও তিন শিশু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি ৪৬ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএসএম জাকারিয়া বলেন, 'এই সাতজনই বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের পরিচয় যাচাই করা হয়েছে। পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার জন্য তাদের কুলাউড়া থানায় হস্তান্তর করা হবে।'
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম আফসার জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। গত আট দিনের মধ্যে এই সীমান্তে দ্বিতীয়বারের মতো এমন ঘটনা ঘটলো।
গত রাতে ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ নারী ও শিশুসহ ৩৯ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে। বিজিবি ৪ ব্যাটালিয়নের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বিএসএফ ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী সীমান্ত দিয়ে ৩৯ বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে। কাগজপত্র যাচাইয়ের পর ১২ জনকে ফুলগাজী থানায় এবং আরও ১২ জনকে ছাগলনাইয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ১৫ জনের ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে।'
ছাগলনাইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, 'তারা ১২ জনই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা। পরবর্তী নির্দেশনা এলে তাদের ব্যাপারে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
'ইতোমধ্যে ১২ জনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, বাকি ১৫ জনের হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে,' বলেন ফুলগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ লুৎফর রহমান।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত থেকে যাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ ২০০৭ সাল থেকে সেখানে বসবাস করছিলেন এবং তাদের বেশিরভাগই ইটভাটায় কাজ করতেন। ফেনীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেছেন, 'বিএসএফের মাধ্যমে ফেরত আসা ৩৯ জনের ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া চলছে।'
কুমিল্লা সদর উপজেলার গোলাবাড়ি সীমান্ত দিয়ে এদিন সকালে বিএসএফ নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১৩ বাংলাদেশি নাগরিককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। বিজিবি কুমিল্লা ১০ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর আলী ইজাজ বলেন, 'অবৈধভাবে প্রবেশের সময় বিজিবির ৬০তম টহল দল ১৩ জনকে আটক করেছে।' তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, তিনজন নারী ও সাত শিশু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হয়েছি, তারা সবাই বাংলাদেশি নাগরিক এবং বিএসএফ তাদের জোর করে সীমান্ত পার করে দিয়েছে। বর্তমানে তারা বিজিবির হেফাজতে আছেন, যাচাই-বাছাই শেষে তাদের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হবে।'
এদিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরচুনা সীমান্ত থেকে ৬৩ ও ৪৫ বছর বয়সী দুই নারী এবং দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রামচন্দ্রপুর সীমান্ত এলাকা থেকে ২৪ ও ১৬ বছর বয়সী দুই ভাইকে আটক করেছে বিজিবি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চারজনই জানিয়েছেন যে, তারা দালালের মাধ্যমে কাজের জন্য ভারতের গুজরাটে গিয়েছিলেন এবং সেখানে পাঁচ থেকে ১০ বছর ছিলেন—জানিয়েছেন একজন বিজিবি কর্মকর্তা।
বিজিবি দিনাজপুর ৪২ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মঈন হাসান বলেন, ভারতীয় পুলিশ প্রায় এক মাস আগে তাদের আটক করে এবং ৬৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কাছে হস্তান্তর করে। পরে তাদের ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
আজ ভোরে রামগড় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পর পাঁচজনকে আটক করেছে বিজিবি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইসমত জাহান এ তথ্য জানিয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জানিয়েছে, তারা হরিয়ানার একটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পাঁচজনকে সাময়িকভাবে রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন ও রামগড় পুলিশ যৌথভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে, বলেন তিনি।
যা বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, নয়াদিল্লি আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, ভারতে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন, যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই।
'বাংলাদেশিদের জোর করে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছি এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি। তবে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমরা কোনো যথাযথ ব্যাখ্যা পাইনি,' বলেন এই কর্মকর্তা।
যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, যা উভয় দেশের জন্যই প্রযোজ্য। যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দেরি হলে জোর করে ঠেলে দেওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।'