ঢাকা
খ্রিস্টাব্দ

নিয়মিত অফিসে আসেন না রেলের কর্মীরা, সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে

দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ


আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন


নিউজটি দেখেছেনঃ 1845367 জন

  • নিউজটি দেখেছেনঃ 1845367 জন
নিয়মিত অফিসে আসেন না রেলের কর্মীরা, সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে
ছবি : সংগৃহীত

সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে কিংবা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু এ বিধিমালার তোয়াক্কা করছেন না রেলওয়ে কর্মচারীরা। নিয়মিত অফিস না করলেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে একজন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক বি এন এফ সুমন।



কমলাপুর রেলস্টেশনে পার্সেল শাখায় অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন তিনি। 

অভিযোগ উঠেছে, সুমন নিয়মিত অফিস করেন না। তিনি কমলাপুরে এলেও যুক্ত থাকেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। 


জানা গেছে, ২০১৫ সালে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের প্রধান সহকারী পদ থেকে অবসরে গেছেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সভাপতি মো. হুমায়ন কবির।



সুমন তার সহোদর। ২০১০ সালে রেলে সুমনের চাকরি হয়। আলোচনায় রয়েছে, হুমায়ন কবিরের তদবিরে সুমনের চাকরি হয়েছে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে হুমায়ন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরীক্ষা দিয়ে নিয়ম অনুযায়ী সুমনের চাকরি হয়েছে।



সুমন নিয়মিত অফিস করে। যেহেতু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই মাঝেমধ্যে মিটিং-মিছিলে যেতে পারে।’

শুধু সুমনই নয়, শাহজাহানপুরের বাসিন্দা কামরুল জাহান কমল স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কমলাপুরে ওয়েম্যান পদে চাকরি করলেও তিনি কাজে আসেন না বলে সহকর্মীরা জানিয়েছেন।


সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর বিধি-২৫-এর উপবিধি-১ অনুসারে কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।


 

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজনের নামে অন্যজনের কাজ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু এমনটা যে হচ্ছে, সেটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন। সব জেনেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। দুর্নীতি যে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেছে—এটা তার প্রমাণ।’


এদিকে অভিযোগ উঠেছে চাকরি রেললাইনে হলেও কাজ করছেন দপ্তরে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ২০১৬ সাল থেকে ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে কাজ করছেন ইকবাল হোসেন। কিন্তু ২০১৪ সালে পাবলিক ওয়ার্কসের (পিডাব্লিউ) অধীনে ওয়েম্যান পদে তার নিয়োগ হয়। যেখানে তার মাঠে থাকার কথা, সেখানে প্রায় আট বছর ধরে তিনি কাজ করছেন দপ্তরে।


গত ১৯ মার্চ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের দপ্তরে গিয়ে ইকবাল হোসেনকে কম্পিউটার অপারেটরের কাজে দেখা যায়। পরে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, দপ্তরে জনবল সংকটের কারণে তিনি এখানে কাজ করছেন। থাকার জন্য শাহজাহানপুরের ‘এ টাইপ’ কলোনি বরাদ্দ পেয়েছেন।


ওয়েম্যানের পদে থেকে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে কাজ করা অন্য চারজন হলেন সৈয়দ আলী আকবর, সোহেল মিয়া, রুমা আক্তার ও সালমা বেগম। তারা ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলীর দপ্তর ও ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের দপ্তরে কাজ করছেন।


রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, এমন ঘটনা আগে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এখন এসব কমিয়ে আনা হয়েছে। জনবল সংকটের সুযোগ নিয়ে অনেক কর্মকর্তা এসব প্রশ্রয় দেন। এত নিচের খোঁজ সব সময় ওপর থেকে পাওয়া যায় না। তবে এসব ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 


জেনেশুনে নীরব কর্মকর্তারা 


এসব ঘটনা জানলেও কর্মকর্তারা অনেকে নীরব থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলীর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এসে যাঁদের পেয়েছি, তাদের বাদ দিইনি। তাঁদের দিয়ে আমার কাজ চলে যাচ্ছে। এখানেও লোকের দরকার।’


রেলওয়ের তথ্য বলছে, পয়েন্টম্যান, খালাসি ও ওয়েম্যানের মতো চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৪৭ হাজার ৬৩৭টি পদ রয়েছে। এর বিপরীতে বর্তমানে চাকরি করছেন ২৪ হাজার ৪০৩ জন। বাকি ২৩ হাজার ২৩৪টি পদে জনবল নেই। যদিও গত ২৪ ডিসেম্বর ওয়েম্যান হিসেবে এক হাজার ৭৬৭টি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।


এ বিষয়ে ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ এস এম ফেরদৌস আলমের সঙ্গে কালের কণ্ঠ’র কথা হয়। তখন তিনি ঢাকার বিভাগীয় ব্যবস্থাপক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্যই আইনের ব্যত্যয়। কিন্তু সেই লোকগুলোকে তো মাঠে না হোক, অফিসের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেও দেখা যেতে পারে।’


জবাবদিহির অভাবে রেলপথে ঝুঁকি বাড়ছে


রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত একটি দলকে কারিগরি ভাষায় ‘গ্যাং’ বলা হয়। একটি গ্যাংয়ের অধীনে দুই থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত রেললাইনের দায়িত্ব থাকতে পারে। পথের ব্যস্ততা ও লাইনের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে কাজের এলাকা নির্ধারিত হয়। এক দলে পাঁচ থেকে ১২ জন পর্যন্ত সদস্য থাকে।


গ্যাং প্রধানকে মেড বা মিস্ত্রি বলা হয়। দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কিম্যান বা চাবিওয়ালা পদে রাখা হয়। এই দলের বাকি সবাই ওয়েম্যান হিসেবে কর্মরত থাকেন। রেলওয়ের এই পদগুলো সবই ব্রিটিশ সরকারের চালু করা। তাই নামগুলোতে ইংরেজির ছোঁয়া এখনো রয়ে গেছে। মূলত যে ব্যক্তি রেলপথে কর্মরত থাকেন, তাঁকে ওয়েম্যান বলে ডাকা হয়।


ওয়েম্যানের কাজ হচ্ছে, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় কাজ করা। সেই সঙ্গে ট্রেন চলাচলের জন্য রেললাইন যেন উপযোগী থাকে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। আবার দুর্ঘটনা ঘটলে লাইন মেরামত, দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনকে মূল লাইন থেকে অপসারণ করার ক্ষেত্রেও ওয়েম্যানরা সরাসরি দায়িত্ব পালন করে থাকেন।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রোদ, বৃষ্টি, শীত সব পরিস্থিতিতে ওয়েম্যানকে রেললাইনে থাকতে হয়। তাই সুযোগ পেলেই তাঁরা অন্য কাজে সরে যেতে চান। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য থাকে ঢাকায় বদলি হওয়া। তারপর কোনো দপ্তরে ঢুকে যাওয়া।


অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে স্পষ্ট যে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নৈতিকতা নেই। কোনো জায়গায় যদি অতি যোগ্য লোককে চাকরি দেওয়া হয়, তাহলে তাঁকে দিয়ে সেই কাজ হবে না। যেমনটা অযোগ্য লোককে দিয়েও হবে না। আমরা অতি উন্নয়নের গতিতে অবকাঠামোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভুল করছি।’ 


নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ এলএসবিডি/হেনা

কমেন্ট বক্স
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ



আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন