চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিস্তৃত খালগুলো একসময় ছিল জলাধার ও পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই খালগুলো এখন রূপ নিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণঘাতী ফাঁদে। অব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় চট্টগ্রামের অধিকাংশ খালই বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে প্রাণনাশী দুর্ঘটনা।
নগরীর হেমসেন লাইন, বহাদ্দারহাট চাক্তাই খালের মুখ, মুরাদপুর, রাজাখালি এবং চামড়ার গুদাম এলাকার খালগুলো বিশেষভাবে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব খালের পাশ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চলাচল করেন। কিন্তু অধিকাংশ খালের পাশেই নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যেমন রেলিং বা নিরাপত্তা দেয়াল।
গত কয়েক মাসে এসব এলাকায় একাধিক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সম্প্রতি চকবাজারের কাপাসগোলা এলাকার হিজড়া খালে পড়ে যাওয়া এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। পরে চাক্তাই খাল থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।এছাড়া হেমসেন লাইন এলাকায় তিন বছর বয়সী এক শিশু খেলতে খেলতে খালে পড়ে যায় পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করলেও সে গুরুতর আহত হয়। মুরাদপুর এলাকায় সন্ধ্যার পর খালের ধারে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যান এক বৃদ্ধ। ভাগ্যক্রমে আশপাশের মানুষের সহায়তায় তিনি বেঁচে যান। চাক্তাই খালের পাশে চলন্ত অবস্থায় সাইকেলসহ এক যুবক খালে পড়ে গুরুতর আহত হন।
এ ধরনের অসংখ্য দুর্ঘটনা শুধু যে আহত হওয়ার কারণ হচ্ছে তাই নয়, অনেক সময় প্রাণহানিও ঘটছে। রাজাখালি এলাকায় কয়েক বছর আগে এক স্কুলছাত্র খালে পড়ে মারা যায়। চামড়ার গুদাম এলাকার একটি খালে কয়েক মাস আগে পাওয়া যায় এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ। বর্ষার শুরু থেকেই বাড়তে থাকে এসব দূর্ঘটনা যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
বহাদ্দারহাট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হাসান মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “প্রতিদিন আতঙ্কে চলি। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর খালের পাশ দিয়ে হাঁটা খুবই বিপজ্জনক। ছোট ছেলেমেয়েদের তো একদমই খালের পাশে যেতে দেই না।”
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বিভিন্ন সময়ে খাল উন্নয়ন এবং সংস্কারের প্রকল্প হাতে নিলেও বাস্তব অগ্রগতি খুবই সীমিত। অধিকাংশ কাজই থেকে যায় পরিকল্পনার কাগজে-কলমে। কিছু এলাকায় খালের পাশে অস্থায়ীভাবে বাঁশ বা টিনের বেড়া দেওয়া হলেও সেগুলো অল্পদিনেই ভেঙে পড়ে বা অপসারণ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রামের খালগুলো শুধু পানি নিষ্কাশনের জন্য নয়, নগরীর পরিবেশ রক্ষা এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই খালগুলো এখন দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, “প্রতিটি খালের পাশে স্থায়ী রেলিং, পর্যাপ্ত আলো, সতর্কতামূলক সংকেত বোর্ড এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। এসব খাল শহরের হৃদপিণ্ড। এগুলো রক্ষা না করলে শহর নিজেই ভেঙে পড়বে।”
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবহেলা করতে পারছেন না। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। কেউ দায় নিচ্ছেন না, আবার কোনো পক্ষ স্বীকার করছেন না যে এই খালগুলো এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ফলে সাধারণ মানুষকেই প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে।
সচেতন নাগরিকদের মতে, নগর কর্তৃপক্ষের উচিত জরুরি ভিত্তিতে অরক্ষিত খালগুলোর তালিকা করে সংশ্লিষ্ট স্থানে দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাতে দুর্ঘটনা যেমন কমবে, তেমনি নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা ও নিরাপত্তাবোধ বাড়বে।
চট্টগ্রাম নগরীর সার্বিক উন্নয়ন এবং নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য খাল সংস্কার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই খালগুলো আরও বহু প্রাণ কেড়ে নিতে পারে—এ আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।