ঢাকা
খ্রিস্টাব্দ

বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

৩রা মার্চ ১৯৭১, ছাত্র এবং জনতার ঐতিহাসিক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক | দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ
ঢাকা
শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ১.৫৬ অপরাহ্ন

আপডেট : শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ১.৫৬ অপরাহ্ন


নিউজটি দেখেছেনঃ 983884 জন

  • নিউজটি দেখেছেনঃ 983884 জন
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ
৭ই মার্চ, ১৯৭১ -এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। -সংগৃহীত ছবি।

৭ই মার্চ, ১৯৭১, একটি ঐতিহাসিক দিন যা বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের সামনে যে ভাষণ দেন, তা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গীকার ও জাতীয়তাবোধের জাগরণ হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই ভাষণ, বিশ্ব ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছে। শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির পথ নির্দেশিত হয়েছিল সে ভাষণে।বঙ্গবন্ধু উক্ত ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য অচিরেই বিতরণ করা হয়েছিল। মাত্র ১৮ মিনিটের কাব্যিক ভাষণ গোটা জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনন্য এবং অসাধারণ এই কারণে যে, এই ভাষণ সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করেছিল।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে-কোনো উপায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা রক্ষা করা। এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্ত নেন, তবে ১ মার্চ আচমকা সেই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। এই খবর শোনার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপক প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে বৃহত্তর হরতাল অনুষ্ঠিত হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তিনি পূর্ব বাংলায় ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই পরিস্থিতিতে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে একটি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এবং পুরো ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এই বিশাল জনতার সামনে, শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, যা সার্বিক জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে ওঠে।

ভাষণের সেই মুহূর্তে, বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। এই বাক্যটি স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সুর হয়ে দাঁড়ায় এবং তৎকালীন বাঙালি জাতির সংগ্রামের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু সেদিন যে ভাষণ দেন, তা শুধু রাজনৈতিক ভাষণ নয়, এটি ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের রণকৌশলও।

এ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তুলে ধরেন, পাশাপাশি, তিনি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা দেন। এ ভাষণ ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার।

৩রা মার্চ ১৯৭১, ছাত্র এবং জনতার ঐতিহাসিক সমাবেশে, তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ. স. ম আব্দুর রব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা ৭ কোটি বাঙালির অনুভূতির প্রতিফলন ছিল।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা এ ভাষণের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) তথা আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটি সহ মোট ৭৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। যা ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে, লাখো মানুষের উল্লাসপূর্ণ স্লোগানের মধ্যে, বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়তে থাকে। তাঁর ভাষণ ছিল এক অগ্নিবাণী, যা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে তীব্র করে তোলে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, "রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।" এটি ছিল স্বাধীনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত ঘোষণা।

মুজিবুর রহমান সেইদিন উল্লেখ করেছিলেন যে, "আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।" এর মাধ্যমে তিনি দেশের জনগণকে সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।

এই ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, যা পরবর্তীতে দেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তিতে পরিণত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অমর দিকনির্দেশনা হয়ে রয়ে যায়।

জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন তা মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ। বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক নেতার বিভিন্ন আলোচিত ভাষণ রয়েছে। তবে কোনও নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এ ভাষণটির মাধ্যমে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দেন।



 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ:

ভাইয়েরা আমার; আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।

আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।

তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলীতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলীর মধ্যে আলোচনা করবো; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলী। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলীতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলী চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলী বন্ধ করে দেওয়া হলো।


ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেম্বলী ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

কি পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলী। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলী করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকব।

আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।

ভাইয়েরা আমার...
২৫ তারিখে এসেম্বলী কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বলী কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথ্ড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলীতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলীতে বসতে আমরা পারি না।

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্ণমেণ্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।

২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল,- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলী চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্ত্তত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা। জয় বাংলা।



নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ এলএসবিডি/এনকেডি

কমেন্ট বক্স
বাংলাদেশ | জাতীয়
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক | দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ
ঢাকা
শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ১.৫৬ অপরাহ্ন
আপডেট : শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ১.৫৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ