ভেরোনিকা খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলতে পারেন মৌলভীবাজারের দুই নারী। তারা সম্পর্কের বোন। তাদের ছাড়া এই ভাষার সঙ্গে পরিচয় নেই কারও। ফলে কথা বলার সঙ্গী পান না।
এ অবস্থায় তাদের মৃত্যু হলে খাড়িয়া নামের ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও সংস্কৃতি। এই দুই নারী শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া চা-বাগানের বস্তিতে বসবাস করেন। একজনের নাম ভেরোনিকা কেরকেটা, আরেকজনের নাম খ্রিস্টিনা কেরকেটা। তাদের বয়স যথাক্রমে ৭৭ থেকে ৮২ বছর। ভেরোনিকা কেরকেটা বড় আর খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছোট বোন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চা বাগানগুলোর ৪১টি শ্রমিক লাইনে খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর বাস। সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা আদিবাসী গোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০২০ সালে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের চা বাগানগুলোতে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর হাজারের মতো মানুষের খোঁজ পাওয়া গেলেও ভেরোনিকা ও খ্রিস্টিনা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।
বড় বোন ভেরোনিকা কেরকেটার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা দুই বোন মারা গেলে এ ভাষাও শেষ। আর কেউতো এ ভাষা বলতে পারে না।’
আমরা কথা বলতে পারলেও লিখতে পারি না উল্লেখ করে ভেরোনিকা কেরকেটা বলেন, ‘খাড়িয়া সমাজে মাত্র ১৫-২০ জন হবে; যারা খাড়িয়া ভাষার কয়েকটা মাত্র শব্দ জানে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কেউ এই ভাষায় কথা বলতে পারে না। এজন্য তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে।’
ভেরোনিকা কেরকেটা জানান, ‘তার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-পুতি কেউ এ ভাষায় কথা বলতে আগ্রহী নয়। তারা বাংলাকেই বেশি পছন্দ করে। তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন ঘরের লোকদের মাতৃভাষা খাড়িয়া শেখাতে; কিন্তু হয়নি।’
ক্রিস্টিনা কেরকেটা জানান, ‘তাদের দুই বোনের মৃত্যুর পর আর খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার কেউ থাকবে না। তার দাবি সরকার এ বিষয়ে যেন উদ্যোগ নেয়। মুণ্ডা বা খাড়িয়া সম্প্রদায়ের আদি নিবাস ভারতের নাগপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে। ব্রিটিশরা একসময় এ অঞ্চলে চা চাষের কাজে তাদের নিয়ে আসে। সেই থেকে তারা এখানে রয়েছে। এদেশে তাদের ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। তবে ভারতে রোমান হরফে রয়েছে তাদের বর্ণমালা।’
একই পরিবারের সন্তান হিলারুস সরেং খাড়িয়া বলেন, ‘মা ও মাসি ছাড়া আমরা কেউ এ ভাষা জানে না। মা-মাসি তাদের ভাষায় কথা বললে ঘরের ছেলেমেয়েরা না বুঝে হাসাহাসি করে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলার মংরা বস্তিতে বাস করা ৭২ বছর বয়সী দয়াময় খাড়িয়া বলেন, ‘এই এলাকার ১১০টি খাড়িয়া পরিবারের বসবাস। অথচ মাত্র দুইজন এই ভাষায় কথা বলতে পারেন।’
চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলা। এ জেলায় বৈচিত্র্যময় প্রায় ২০টি ভাষায় কথা বলার লোক আছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষা হচ্ছে—খাড়িয়া ভাষা। খাড়িয়া ভাষা টিকে রাখতে ২০১৭ সালে বর্মাছড়া বাগানের উত্তরণ যুব সংঘের মাধ্যমে গঠন করা হয় বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার নামে ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রটি। প্রাথমিকভাবে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মাধ্যমে কিছু শিশুকে খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় সেখানে। এতে কোনো সফলতা আসেনি।
পিউস নানোয়ার খাড়িয়া সমাজকর্মী। তিনি খাড়িয়া ভাষারক্ষার উদ্যোক্তা। যিনি ২০২০ সালের শুরুর দিকে খাড়িয়া জনসংখ্যার ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ৪১টি গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ জন খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর মানুষের খোঁজ পেয়েছি আমরা। নতুন প্রজন্ম এই ভাষায় কথা বলে না; তারা খুব কমই একটি বা দুটি শব্দ জানে। ৯০-এর দশকে স্কুলছাত্র থাকাকালীন আমি দাদির কাছ থেকে কিছু শব্দ শিখেছিলাম। ২০১৭ সালে ‘বীর তেলেঙ্গা খারঢ়য়া ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং সেন্টার’ নামে একটি যুব সংগঠনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ভাষা শেখানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চেষ্টায় কোনও সফলতা পাইনি। কারণ, বাংলাদেশে খাড়িয়াদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই।’
শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী জানান, দেশের চা বাগানগুলোর মধ্যে অধিকাংশতেই আদিবাসী গোষ্ঠীর বিচিত্র ভাষাভাষী মানুষের বাস। তাদের অনেক ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার অভাবে বিপন্ন। খাড়িয়া তার মধ্যে একটি। এটি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক। এ জনগোষ্ঠী সাদ্রিবাংলা, দেশোয়ালি ও মূল খাড়িয়ার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলেন। প্রকৃত খাড়িয়া ভাষা দুই বোনের মৃত্যুর পর হারিয়ে যাবে।’
কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক দীপংকর শীল বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের মাতৃভাষা রক্ষায় আগের চেয়ে অনেক সচেতন। তবে সরকারিভাবে তাদের উৎসাহ প্রদান করলে তাদের মাতৃভাষা চর্চা ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যেহেতু দুই নারী ছাড়া দেশে আর কেউ ভাষাটি জানেন না, বোঝেন না বা চর্চা করেন না; তাই সহজেই অনুমেয় যে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাষা খাড়িয়া।
জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ এফ এম জাকারিয়া বলেন, ‘খাড়িয়া ভাষার শেষ মানুষগুলো মারা যাবে দুই-এক বছরের মধ্যে। খাড়িয়া ভাষায় এখনও যারা কথা বলছেন, তাদের মুখ থেকে গল্প, গানগুলো রেকর্ড করে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। নয়তো অল্প কিছু দিনের মধ্যে হারিয়ে যাবে এই ভাষা।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় প্রশাসনিকভাবে সবধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। খাড়িয়া ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। কারণ, এ ভাষায় এখন কথা বলার মতো লোক নেই। এ ভাষায় শুধু দুই বোন কথা বলতে পারেন। ভাষাটি সংরক্ষণে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহন করা হবে।’
লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষার প্রতিও দায়িত্ববোধ বেড়ে গেছে। তবে অনেকেই নিজস্ব ভাষা চর্চা করেন না। ফলে বাংলা ভাষা তাদের গ্রাস করছে। সরকারিভাবে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজন।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষাসহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটি সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত ভাষা খাড়িয়া।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা গবেষণা ইনিস্টিউটের মতে, দেশে বিপন্ন চৌদ্দটি ভাষার মধ্যে অন্যতম বিপন্ন ভাষা খাড়িয়া ভাষা।