কুমিল্লায় এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। গত রোববার রাতে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সোমবার সকালে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ কথা জানিয়েছে। বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চৌদ্দগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে মানহানির ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। এতে বলা হয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, আব্দুল হাই হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি। এতে ড. ইউনূস আরও বলেন, আমরা সবাইকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ঘটনায় গত রোববার রাত ১০টার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে। এদিকে ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন তিনি। জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানু চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সদস্য ছিলেন। হত্যাসহ ৯ মামলার আসামি কানু, ছিল প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার প্রথম দিকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। যে কারণে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন তিনি ও তার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে অনেকের সঙ্গেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন কানু। একটা সময় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও বাঁধে বিরোধ। দলের নেতাকর্মীদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯ মামলা রয়েছে থানায়। এ ছাড়াও একাধিকবার তিনি কারাগারেও গিয়েছেন নানা অভিযোগে। একসময় নিজ এলাকার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানির নানা অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ভিন্ন দল করায় ভাতা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগও রয়েছে। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তারুজ্জামান বলেন, ঘটনার পর আমরা তার নথি দেখে দুটি মামলার তথ্য পেয়েছি, যার একটি হত্যা মামলা। দুই মামলাতেই তিনি এজাহারভুক্ত আসামি। তবে তিনি নিজের মুখে সবার সামনেই বলেছেন তিনি ৯ মামলার আসামি এবং ১৪বার জেল খেটেছেন। অনলাইন সিস্টেমে ত্রুটি থাকাতে এখনি সব মামলার তথ্য বের করতে পারিনি। জানা গেছে, ঘটনার পর গত রোববারই এলাকা ছাড়েন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিরাপত্তার শঙ্কায় তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। পুলিশ, স্থানীয় জনতা ও আত্মীয়স্বজনরা খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি মোবাইল ফোনে কাউকে কিছুই বলেননি।
তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, তিনি আরেক জেলায় তার মেয়ের বাড়িতে আছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে সূত্রটি বিস্তারিত উল্লেখ করেনি। এই বিষয়ে জানতে তার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লবকে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে তৎপর রয়েছে পুলিশ প্রশাসন। গত রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তারুজ্জামান। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে আশ্বাস দেন।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চৌদ্দগ্রামে ছিলেন কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আরাফাতুল ইসলাম। এই ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করতে। এসব তথ্য জানিয়েছেন চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি। ভাইরাল হওয়া ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তিসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুকে ধরে আনেন। লাল কটি ও পাঞ্জাবি পরা বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় তখন জুতার মালা। এ সময় পাশ থেকে একজন বলছেন, তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। অপরজন বলছেন কুমিল্লা থেকে বের হয়ে যেতে। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানু আকুতি করে বাড়ি থেকে বের হবেন না বললে মধ্যবয়সী ব্যক্তি বলেন, আমরা এত বছর বাড়িতে থাকতে পেরেছি? এ সময় আরেকজন বলে ওঠেন আপনি পুরো গ্রামের মানুষের কাছে মাফ চাইতে পারবেন? এ সময় তিনি হাতজোড় করে সবার কাছে ক্ষমা চান। একপর্যায়ে তাকে দুই হাত ধরে দুজন ব্যক্তি সামনের দিকে নিয়ে যান।
ভিডিওর তথ্যমতে, ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া ও ব্লেজার পরা মধ্যবয়সী সেই ব্যক্তির নাম হাশেম মজুমদার। তিনি বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একজন প্রবাসী। এ ছাড়াও ঘটনায় জড়িত অন্যরা হলেন স্থানীয় কুলিয়ারা গ্রামের রাসেল মজুমদার, ওহিদ, নয়ন। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, তারা জামায়াতের সমর্থক। অনেকে বলছেন, বিগত দিনে জামায়াত আখ্যা দিয়ে বাড়িতে থাকতে না দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন তারা। তবে জামায়াতের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এ ঘটনায় জড়িত কারও সম্পর্ক নেই বলে এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সেক্রেটারি মু. বেলাল হোসাইন। তিনি বলেন, গতকাল (গত রোববার) থেকে আজ (গতকাল সোমবার) পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় জামায়াতকে জড়িয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে নিন্দনীয় প্রচারণা হচ্ছে আমরা তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। কাউকে অপমানজনিত এরকম কার্যক্রমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনও সম্পৃক্ততা নেই। আইন হাতে তুলে নেওয়া জামায়াত সমর্থন করে না।
প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আপনারা এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তবে আমরা এটা জানতে পেরেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুর সামাজিক, পারিবারিক ও নিজ দলের কর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ রয়েছে। যে কারণে এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছে কিনা জানি না। তবে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। উল্লেখ্য গত রোববার সকালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষক লীগ নেতা আব্দুল হাই কানু বাজার করতে বের হন। এ সময় তাকে স্থানীয় কয়েকজন ধরে নিয়ে যায় কুলিয়ারা হাইস্কুলের সামনে। সেখানে তারা তার গলায় জুতার মালা পরায় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে। এ ঘটনার পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন নির্যাতনের শিকার সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই সঙ্গে পালিয়েছেন ঘটনায় জড়িতরাও।