ঢাকা
খ্রিস্টাব্দ

বঞ্চনায় শেষ মালয়েশিয়ার স্বপ্ন

বিদেশে কর্মসংস্থান
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ


আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন


নিউজটি দেখেছেনঃ 1865245 জন

  • নিউজটি দেখেছেনঃ 1865245 জন
বঞ্চনায় শেষ মালয়েশিয়ার স্বপ্ন
ছবি : সংগৃহীত

বিদেশে কর্মসংস্থানে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার গতকাল শুক্রবার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট বা চক্রের নির্মম দুর্নীতির চিত্র। তাদের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে প্রতারিত হয়েছেন হাজারো কর্মী, যার চিত্র গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা গেছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মীকে অনিশ্চয়তার মধ্যে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।


গতকাল মালয়েশিয়া যেতে শেষবারের চেষ্টায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমবেত হন বঞ্চিত কর্মীরা। এসব কর্মীর মধ্যে বেশির ভাগই জমি বা শেষ সম্বলটুকু বেচে ও চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার টাকা জোগাড় করেন। নির্দিষ্ট সময় শেষে নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের মাধ্যমে তাঁদের সে আশা শূন্যে মিলিয়ে গেছে।


হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সূত্র বলছে, গতকাল বাংলাদেশ থেকে ১২টি ফ্লাইট মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এসব ফ্লাইটে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন।

গতকাল সকাল থেকে বিমানবন্দরে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী অবস্থান করেন। কর্মীদের দাবি, এজেন্সিগুলো টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে বলে তাঁদের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু সে টিকিট কখন দেবে, ওই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন কর্মীরা।


প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আজকের (গতকাল) অনলাইন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আজ রাত পর্যন্ত যত কর্মী যাবেন, সবাইকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।


কর্মীদের হাহাকার

কর্মীদের মধ্যে অনেকে তিন-চার দিন ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন। এই কয়েকটি দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে সময় কেটেছে তাঁদের। রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের মাধ্যমে ২৪ জন কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু তিন দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করেও তাঁরা টিকিটের দেখা পাননি।


গতকাল নওগাঁর বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘মালয়েশিয়া যেতে না পারলে আর বাড়ি ফেরা হবে না। জমি বন্ধক রেখে, সুদে ও কিস্তিতে ঋণ করে ছয় লাখ টাকা জোগাড় করেছি। যদি মালয়েশিয়া না-ই যেতে পারি, না-ই কাজ করতে পারি, এই টাকা আমি দেব কোথা থেকে?’


জামালপুরের বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, ‘আজকে যেতে না পারলে তো পুরো নিঃস্ব হয়ে যাব। তারা টাকা ফেরত দেবে কি না, সঠিক জানি না। জমি বেচে, সুদে ও কিস্তিতে ঋণ করে ছয় লাখ টাকা জোগাড় করেছি। এখন যেতে না পারলে বাড়ি কিভাবে ফিরব জানি না।’


একই জেলার বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে শুধু বিমানবন্দরে ঘুরতে আছি। গত পরশু বাড়ি থেকে নিয়া আসছে। বলে—তোমরা তাড়াতাড়ি আসো, তোমাদের টিকিট দেব। এখন টিকিটও পাই না, কিছু বলেও না। নদীর মাঝে ডুবে মানুষ যেমন হাবুডুবু খায়, আমাদের ওই রকম অবস্থা।’


শুধু সাইফুল্লাহ, রুবেল বা সালমা বেগম নন, বিমানবন্দরজুড়ে এমন হাজারো কর্মীর মধ্যে এই হতাশা। পটুয়াখালী থেকে এসেছেন মো. শফিক শিকদারসহ পাঁচজন। কিন্তু টিকিটের সুরাহা হয়নি।


শফিক শিকদার বলেন, ‘এখন আমাদের বলছে যে আপনারা যদি টিকিট কাটতে পারেন, তাহলে কেটে চলে যান। এখন ব্যাপারটা যদি আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে আমরা এদের কাছে কেন গেলাম? কেন তাহলে তখন বলল যে তারা সব কিছু করে দেবে। এখন আমাদের মাথার ওপর ভার চাপিয়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোনো ফ্লাইট পাওয়ার সুযোগ নেই। এখন শুধু অন্ধকার দেখছি। অনেক কষ্টে সুদের ওপর ঋণ করে টাকা নিয়ে আসছি। এই কিস্তির টাকা প্রতি সপ্তাহে দিতে হবে। এটা ঠিকমতো দিতে না পারলে আমার নামে মামলা করে দেবে তারা।’


খুলনার বাসিন্দা শিহাব মোল্লা বলেন, ‘দালাল শুধু বলতাছে টিকিট আছে, দিচ্ছি, বিমানবন্দরে আসেন। এ রকম তিন দিন ধরে ঘোরাচ্ছে। প্রতিদিনই শুধু আসি আর যাই। এখন টাকা তো তাদের হাতে। আমরা তাদের কাছে জিম্মি। তারা যা করছে, আমাদের তা-ই মানতে হচ্ছে। এখন বলতাছে, আজকে হবে। কিন্তু কখন হবে, তা বলতাছে না।’


এ বিষয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) যুগ্ম সম্পাদক টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩১ তারিখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটা সবাই আগে থেকে জানত। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে যদি অধিকসংখ্যক চার্টার্ড ফ্লাইট করা যেত, তবে এ সমস্যা অনেক আগেই দূর করা যেত। আমরা মনে করি, সরকারের উদ্যোগের অভাব ছিল। এখনো সরকারই পারে যাঁরা ভিসা পেয়েছেন,  কূটনৈতিকভাবে তাঁদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।’


এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘কত মানুষ যাবে, কিভাবে যাবে, সেই তালিকা চেয়েছিলাম বায়রার কাছে। কিন্তু তারা কোনো তালিকা দিতে পারেনি। এর ফলে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে এখন যাঁদের টিকিট কনফার্ম হয়েছে, তাঁদের পাঠানো হচ্ছে। অন্যদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’


দুর্নীতির আখড়া যে শ্রমবাজার

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যেন দুর্নীতির আখড়া। সরকার অভিবাসন খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করলেও কর্মীরা জনপ্রতি সাড়ে চার থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। আইনে নিষিদ্ধ হলেও ভিসা কেনাবেচার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ভিসা ন্যূনতম ছয় হাজার রিঙ্গিত করে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কিনেছে।


নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের হোতাদের কর্মীপ্রতি এক লাখ ৪২ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে যাওয়া কর্মীরা পাননি কোনো কাজ। বেতন ও কাজ না পাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন লাখো কর্মী। 


এ বিষয়ে গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম বলেন, ‘সিন্ডিকেট এমন একটি বিষয়, যা মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে এর সমাধানের জন্য দুই দেশের সরকার পরস্পরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’ 


বায়রার যুগ্ম সম্পাদক বলেন, ‘আমরা চাই দেশের সব এজেন্সি সব দেশে কর্মী পাঠাক। কোনো কারণে সিন্ডিকেশন আমরা চাই না।’


প্রথমে ২৫, পরে ১০১ সিন্ডিকেট

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৯ সাল থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। দীর্ঘ ছয় বছর পর আবার কর্মী নেওয়া শুরু হলে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর কাজ পায়, যারা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। সে সময় ৩৭ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করা হলেও এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে নিত তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এই দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে আবারও বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট এই শ্রমবাজার পুনরায় চালু হয়। তবে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ২৫ বাংলাদেশি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া সরকার। কিন্তু বঞ্চিতদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেটবিরোধী আন্দোলনের পর আরো ৭৫ বেসরকারি ও একটি সরকারি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয় মালয়েশিয়া। 


সিন্ডিকেটে মন্ত্রী-এমপিরা

মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটে মন্ত্রী-এমপিদের রিক্রুটিং এজেন্সির নামও উঠে এসেছে। তবে তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারেনি।


বিএমইটির তথ্য বলছে, প্রথম ২৫টি এজেন্সি বাদে অন্য সব এজেন্সি সমপরিমাণ কর্মী পাঠিয়েছে। এ সংখ্যা সাত হাজার থেকে আট হাজার। জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকজন এমপির প্রতিষ্ঠান আদতে কোনো কর্মী পাঠায়নি। তারা অন্য এজেন্সির কাছে কর্মীপ্রতি চাহিদাপত্র ৩৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করত।


বিএমইটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজীর আহমেদের আহমদ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৪৬)। গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সাত হাজার ৮৬৯ জন কর্মী পাঠিয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটে ঢোকার আগে প্রতিষ্ঠানটি সাত বছরে মাত্র ৩৮৭ জন কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছিল।


ভোগান্তির যেন শেষ নেই

মালয়েশিয়ার প্রবাসীদের ‘কাজের খবর’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। এর সদস্য ৭০ হাজার। প্রতিদিন এই গ্রুপে কয়েক শ কর্মী কাজের খোঁজ করেন। তাঁরা ছয় মাস, সাত মাস এমনকি এক বছর ধরে বেকার জীবন যাপন করছেন।


কর্মীদের এই কাজ না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন বলেন, ‘আপনারা যেভাবে বলেন এবং প্রচার করেন, সে রকম পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। আমরা প্রতিদিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র পাঁচ হাজার ১৯০ জন কর্মী এখন পর্যন্ত কাজ পাননি।’ কিন্তু মালয়েশিয়ার সূূত্র বলছে, মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া কয়েক লাখ কর্মী কাজ পাননি।


অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘এই সময়টা মালয়েশিয়া অনেক আগেই নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু এই প্রসেসিংয়ে সময়ের চেয়ে কর্মী বেশি ছিলেন। ফলে এই প্রক্রিয়ার দ্রুততার প্রয়োজন ছিল। আর যাঁরা গেছেন সবাই যে কাজ পাবেন, তারও কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন এটা মনিটর করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সিন্ডিকেট, দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করা প্রয়োজন, যে কমিটি এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে পারবে।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ামালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য উড়োজাহাজের টিকিট ছাড়াই হাজারো মানুষ গতকাল সকাল থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করে।


নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ এলএসবিডি/হেনা

কমেন্ট বক্স
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ



আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন