ঢাকা
খ্রিস্টাব্দ

রুয়েটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতার দাপট, প্রভাব খাটিয়ে চাকরি-পদোন্নতি

দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ


আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন


নিউজটি দেখেছেনঃ 1885166 জন

  • নিউজটি দেখেছেনঃ 1885166 জন
রুয়েটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতার দাপট, প্রভাব খাটিয়ে চাকরি-পদোন্নতি
ছবি : সংগৃহীত

প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সনদ না থাকা সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান শাহ মো. আলবেরুনী ফারুক। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল সেটিও মানা হয়নি তার নিয়োগের ক্ষেত্রে। রুয়েটে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। যোগ্যতা ছাড়াই সহকারী রেজিস্ট্রার হওয়ার পর আরও পদোন্নতি মিলেছে তার। এখন তিনি বনে গেছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার। শাহ মো. আলবেরুনী ফারুক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি। রুয়েটে তার দাপট নিয়ে অনেক জায়গাতেই কানাকানি হলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না কেউ।



খোঁজ নিতে গিয়ে এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে আলবেরুনী ফারুকের নিয়োগ-সংক্রান্ত জালিয়াতির কিছু তথ্য। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উল্টো দম্ভোক্তি করে তিনি বলেন, ‘শুধু আমি নই, এখানে এসএসসি, এইচএসসি, বিএতে থার্ডক্লাস পাসও ডেপুটি রেজিস্ট্রার আছে। তাদের বিষয়েও লেখেন।’



অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুয়েটে পিএস টু ভিসি পদে (উপাচার্যের একান্ত সচিব) নিয়োগের জন্য ২০১১ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পিএস টু ভিসি পদে একজনকে নিয়োগের কথা বলা হয়। ৩৩ জন প্রার্থী আবেদন করেন। তাদের মধ্য থেকে আলবেরুনী ফারুককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ পরীক্ষা ঘিরে ওই সময় ক্যাম্পাসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আলবেরুনী ফারুকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে তৎকালীন উপাচার্যের দপ্তর ঘেরাওয়ের ঘটনাও ঘটে। উপাচার্যের ওপর চাপ তৈরি করা হয়। ২০১২ সালে আলবেরুনী ফারুককে এই পদে চাকরি দেন তৎকালীন উপাচার্য ড. সিরাজুল করিম চৌধুরী।


তার এই পদের আবেদন ও পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পর্যালোচনা করে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি আবেদন ফরমে অভিজ্ঞতার কলামে কাটাকাটি করে লেখা রয়েছে। এই কলামে তিনি তার অভিজ্ঞতার একটি সনদ যুক্ত করেছেন। অথচ পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে তিনি যে তথ্য উল্লেখ করেছেন সেখানে কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে উল্লেখ করেছেন।


তিনি নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিন পরই রুয়েটে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের জন্য ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। এতে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি আবেদনের শেষ সময় বেঁধে দিয়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক/অ্যাকাডেমিক/পরীক্ষা-সংক্রান্ত কাজে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১ বছর ১০ মাসের চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়েই ওই পদে আবেদন করেন আলবেরুনী ফারুক। এ ছাড়া পিএস টু ভিসি পদে চাকরিতে প্রবেশের আবেদন ফরমে কোনো অভিজ্ঞতা সনদ দেওয়া না হলেও সহকারী রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতির আবেদনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার অভিজ্ঞতার সনদ যুক্ত করেন তিনি। প্রায় ৬ বছর ২ মাস চাকরি করার এই অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই নিয়োগে জালিয়াতি করার উদ্দেশ্যে পিএস টু ভিসি পদের আবেদনে তিনি ঘষামাজা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।


অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শাহ মো. আলবেরুনী ফারুক সহকারী রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি পেতে আবেদনের সঙ্গে ১ জুন ২০০৫ থেকে ৩১ জুলাই ২০১১ পর্যন্ত রাজশাহীর একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির অভিজ্ঞতা সনদ যুক্ত করেন, যা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা মানের কোনো পদ নয়। অথচ ওই সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতির দায়িত্বে থাকায় ঢাকায় অবস্থান করতেন। আবার পিএস টু ভিসি পদে নিয়োগের সময় পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফরমে এই অভিজ্ঞতা সনদের অস্তিত্ব না থাকায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিতর্কিত এই সনদ দিয়েই ২০১৫ সালের ১ জুন সহকারী রেজিস্ট্রার বনে যান শাহ মো. আলবেরুনী ফারুক। তবে এখানেই থেমে যাননি তিনি।


পরে সহকারী থেকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে আপগ্রেডেশন পান। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর তার এই আপগ্রেডেশন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি এই পদ পান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।


এদিকে একের পর এক পদ হাতিয়ে নেওয়ার পর তিনি হয়ে উঠেছেন দাপুটে কর্মকর্তা। রুয়েটের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণসহ ক্যাম্পাসে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাওয়ায় রুয়েটের শুদ্ধাচার কৌশল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ‘আকস্মিক পরিদর্শন কমিটি’র সদস্যদের হুমকি প্রদান করার অভিযোগ রয়েছে ফারুকের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, কাফনের কাপড় পাঠিয়ে রুয়েটের ৯ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে হত্যার হুমকি প্রদানের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে আদালতে তলবও করা হয়।


যোগ্যতা না থাকলেও কীভাবে এই কর্মকর্তার নিয়োগ হলো এ বিষয়ে জানতে তৎকালীন উপাচার্য ড. সিরাজুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অসুস্থ। এ কারণে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।


অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে রুয়েটের সাবেক ভিসি রফিকুল ইসলাম বেগ বলেন, ‘এত আগের খবর আমি বলতে পারব না। এটা একটি কমিটি করে দেওয়া হয়, তারা যাচাই-বাছাই করে সেটির জন্য রেজিস্ট্রার দপ্তরে সুপারিশ করে। আমি এগুলো দেখি না। আর এই বিষয়ে বলতেও পারব না। আমার আমলের রেজিস্ট্রারের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’


সে সময়ের রেজিস্ট্রার ড. সেলিম হোসেন বলেন, ‘এটি কীভাবে হয়েছে এখন বলা সম্ভব নয়। তবে আপনারা যেহেতু বলছেন আমি এটি বর্তমান রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আপনাদের জানাতে পারব।’


এ বিষয়ে বর্তমান রেজিস্ট্রার আরিফ আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, ‘যদি কোনো তথ্য গোপন করে বা পরে কাটাছেঁড়া করে, তবে সেটি ফৌজদারি অপরাধ। আমরা বিষয়গুলো তার (ফারুক) কাছে জানতে চাইব। তখন এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। তবে তার ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে আপগ্রেডেশনের ক্ষেত্রেও শিথিলতা করা হয়েছে।’ প্রতিটি পদেই ফরুকের জন্য শিথিলতা কেন জানতে চাইলে কোনো উত্তর দিতে চাননি বর্তমান রেজিস্ট্রার।


সার্বিক বিষয়ে জানতে রুয়েটের উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া মেলেনি। গতকাল শনিবার তার কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।


জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ মো. আলবেরুনী ফারুক বলেন, ‘কোনো অভিজ্ঞতারই পুলিশ ভেরিফিকেশন হয় না। ধরেন অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা কোনো একটা শিথিল করা আছে নীতিমালায়, সেই জায়গা থেকেই ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু আমি নই, এখানে এসএসসি, এইচএসসি, বিএতে থার্ডক্লাস পাসও ডেপুটি রেজিস্ট্রার আছে। তাদের বিষয়েও লেখেন, তারা কীভাবে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হলো। তারপর আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ পেয়েছেন লেখেন। এগুলো সব দিয়ে আমাদের নাম-টাম জড়িয়ে কীভাবে নিউজ করবেন কইরেন।’


নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ এলএসবিডি/হেনা

কমেন্ট বক্স
দৈনিক লাল সবুজ বাংলাদেশ



আপডেট : বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১.১১ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ