News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/eL
দুই লেনের মহাসড়ক ধরে ভাঙ্গা থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে ফরিদপুরের দিকে যাচ্ছিলেন বাবা, ছেলেসহ এক পরিবারের তিনজন। উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের ধাক্কায় তিনজনই গুরুতর আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনজনই। দুর্ঘটনাটি ঘটে গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙ্গা উপজেলার হামিরদীতে।
একই মহাসড়কে গতকাল সকাল ৮টায় আরেকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ইজি বাইককে সামনে থেকে অন্য একটি গাড়ি ধাক্কা দিলে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়। প্রায় একই ধরনের আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে গতকাল ভোরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে, নরসিংদীর পাঁচদোনায়। পাঁচদোনায় ড্রিম হলিডে পার্কের সামনে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মারা যান মাইক্রোবাসের চালক এবং গাড়িতে থাকা ব্যান্ড গায়ক আহসান তানভীর পিয়াল।
তিনটি দুর্ঘটনাই ঘটেছে আঞ্চলিক মহাসড়কে, মুখোমুখি সংঘর্ষে। আর মুখোমুখি সংঘর্ষ তখনই ঘটেছে, যখন একটি গাড়ি নিজের লেন ছেড়ে পাশের লেনে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সড়কের বেশির ভাগই দুই লেনের।
ফলে সামনের গাড়িকে অতিক্রম করতে গিয়ে পেছনের গাড়িটিকে পাশের লেনে চলে যেতে হচ্ছে। দুই লেনের মহাসড়কে লেনভিত্তিক গতির ব্যবস্থা চালুর সুযোগ নেই। আবার যেসব মহাসড়ক একমুখী একাধিক লেনের, সেখানেও লেনভিত্তিক গতি নির্ধারণ করা হয়নি।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সড়কভিত্তিক গতির নির্দেশনা দিয়ে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না, বরং লেনভিত্তিক গতি নির্ধারণ করতে হবে। বেশি গতির গাড়িগুলো প্রথম লেনে চলবে। কম গতির গাড়ি বাঁ দিকের লেনে চলবে। তাহলে গতি নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে।
গতির নির্দেশিকা বাস্তবায়ন হবে কী করে?
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, চার হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক রয়েছে।
সব ধরনের সড়কের জন্য আলাদা গতিসীমা বেঁধে দিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত বুধবার জারি করা সেই নির্দেশিকার বাস্তবায়ন নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে।
নির্দেশিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জেলার সড়কে বাস ও মিনিবাস চলবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে। ট্রাক, মিনিট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মতো পণ্যবাহী যান চলবে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে। আর ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে চলার অনুমতি পেয়েছে মোটরসাইকেল।
এখানে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি তৈরি হচ্ছে, সেটি হলো একই পথে ভিন্ন ভিন্ন গাড়ি ভিন্ন গতিতে চলবে কী করে? এ ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি গতিতে চলার অনুমতি পাওয়া গাড়িগুলোকে কম গতিতে চলার অনুমতি পাওয়া গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। আর পাশ কাটাতে গেলেই পাশের লেনে যেতে হচ্ছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে গতকালের দুর্ঘটনাগুলো এই কারণেই ঘটেছে।
এভাবে গতিসীমা নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, “আমরা বিষয়টা মাত্র শুরু করলাম। আগে তো এটা ছিল না। যেখানে যেখানে ভুল ধরা পড়বে সেখান থেকে শিখব এবং শোধরাব। এটা অনেকটা ‘ট্রায়্যাল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে চলমান থাকবে।”
নির্দেশিকা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আমরা দ্রুত বসব। সেখানে পরিবহন মালিক, চালক, সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগ সবাই থাকবে।’
৪ বছরে মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫,৬৯৩ মৃত্যু
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে সারা দেশে সড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচ হাজার ১৬১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৬৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত সাত হাজার ৪৩৩ জন।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও হতাহত হয়েছে ২০২২ সালে। ওই বছর এক হাজার ৪৫৪টি মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় এক হাজার ৫৯২ জন নিহত হয়। আহত হয়েছে এক হাজার ৯৫৫ জন। বাকি তিন বছর সড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যু বেড়েছে। ২০২০ সালে এক হাজার ১৭৬টি দুর্ঘটনায় এক হাজার ২৯৬ জন নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে এক হাজার ২৪৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হয় এক হাজার ৩০২ জন আর গত বছর ২০২৩ সালে এক হাজার ২৮৪টি মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় এক হাজার ৫০৩ জন নিহত হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ বলছে, গত বছর শুধু ভোররাতে ৬৩ শতাংশ সড়কে মুখোমুখি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগ চালকের চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকার কারণে হয়েছে। চালকদের বিরামহীন গাড়ি চালানো বন্ধ করা গেলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গতিসীমার এই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। এখানে ঢালাওভাবে সব সড়ককে এক করে ফেলা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতুমুখী সড়কে ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালালে দুর্ঘটনা আরো বাড়বে। প্রতিটি সড়ক ধরে মাঠ পর্যায়ে আলাদা নির্দেশনা দরকার।’