News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/2eY
পেঁয়াজ উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলা ফরিদপুর। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে পিছিয়ে নন এ জেলার কৃষকরা। এই বীজকে কালো সোনা বলেন তারা। পেঁয়াজের বীজ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পাড় করছেন চাষীরা। চাষি হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে অংশ নিয়েছেন।
কৃষকরা জানান, সাদা ফুলে কালো বীজ, স্বর্ণের মতো দাম। তাই কৃষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালো সোনা’। দূর থেকে মনে হয়, ভিন্ন কোনো সাদা ফুলের বাগান।
আর এই ফুলের মধ্যে লুকিয়ে আছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ চাষীদের পেঁয়াজের বীজের চাহিদা মেটায় ফরিদপুরের এই কালো সোনা। এ বছর ফরিদপুরে মাঠের পর মাঠ আবাদ হচ্ছে এ বীজের। পেঁয়াজের গাছের গোলাকৃতি কদম ফুলের মতো সাদা ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মূল্যবান দানা। জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় এ বছর বেড়েছে পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ। জেলার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠজুড়ে পেঁয়াজ বীজের সাদা ফুল। হাত দিয়ে পরাগায়নের কাজ করছেন কৃষাক-কৃষাণীরা। পেঁয়াজ ভালো উৎপাদনের পর এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে পেঁয়াজ বীজের।
চাষীরা আরো জানান, বছরের শেষ দিকে আবাদ শুরু, ফলন উঠে নতুন বছরের এপ্রিল-মে মাসে। পরে এক বছর বীজ সংরক্ষণ করে পরের বছরে করা হয় বিক্রি। তবে চলতি মৌসুমে মৌমাছি না থাকায় হাত দিয়েই পরাগায়ন করতে হচ্ছে চাষীদের। তারা জানান, সার, কীটনাশক ও বীজের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর আগের তুলনায় খরচ বেশি হয়েছে। প্রতি একর থেকে ৬-৮ মণ বীজ পাওয়া সম্ভব। প্রতি মন বীজ ৬০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
পেঁয়াজ বীজ চাষি আকমল হোসেন বলেন, 'আমি এ বছর ২০ একর জমিতে আবাদ করেছি। ছোট শিশুর মতো যত্ন করতে হয় পেঁয়াজের বীজের। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো হয়েছে ফলন। ক্ষেতে এখন পরাগায়নের কাজ চলছে। সাধারণত মৌমাছি পরাগায়ন করে থাকে, কিন্তু এ সময়ে মৌমাছি না থাকায় হাত দিয়েই পরাগায়ন করা হচ্ছে। পরাগায়ন করার ফলে ফলন ভালো হয় বিধায় এ কারণে কষ্ট হলেও খুব সাবধানে হাত দিয়ে পরাগায়ন করছি।'
ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুরের নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম ২০০৪ সালে মাত্র ৪০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ শুরু করেন। চলতি বছরে তিনি ১০০ একর জমিতে বীজের চাষাবাদ করেছেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই বীজের আবাদ করে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন তিনি। এআইপি (অ্যাগ্রিকালচারাল ইমপর্টেন্ট পারসন) পুরস্কারসহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার। এ চাষির পথ অনুসরণ করে অনেকেই বীজ আবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম বলেন, 'চলতি মৌসুমে ১০০ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজ আবাদ করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর ভালোই লাভবান হবো। আমার ক্ষেতে প্রায় ৭৫ জন নারী-পুরুষ বীজ পরিচর্যার কাজ করছেন। এখন হাত দিয়ে পরাগায়নের কাজ চলছে। এক থেকে দেড় মাস পর বীজ তোলা শুরু করবো। তারপর মাড়াই এবং প্রক্রিয়াজাত করে বীজ প্যাকেট করা হবে।'
বিদেশে বীজ রপ্তানি করার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শিশু সন্তানের মত সারা বছরই যত্ন করতে হয় পেঁয়াজের বীজের। কারণে আমার বীজের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইতোমধ্যেই অর্ডার পেতে শুরু করেছি।'
সরকারের নজরদারি বাড়ানো আহ্বান জানিয়ে সালথার ভাওয়াল ইউনিয়নের কামদিয়া গ্রামের চাষি নুর ইসলাম জানান, 'ফলন ভালো হলেও দুশ্চিন্তায় থাকি আমরা। কারণ ভারতের বীজ আসা বন্ধ করতে পারলেই আমরা লাভবান হতে পারব। প্রতিবছরই শুনতে পাই, এ বছর ভারত থেকে বীজ আসবে না, কিন্তু বাস্তবে প্রতিবছরই আসে, আর আমাদের লোকসান হয়। এ ছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে তারা ভেজাল বীজ বাজারে বিক্রি করে আমাদের ক্ষতি করে দেয়।' দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফরিদপুরের কাজ করতে এসেছেন শ্রমিকরা। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে থেকে তারা কাজ করেন।
রাজশাহী থেকে আসা ছালাম শেখ বলেন, 'এখানে কাজ করে খুব শান্তি পাই। তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি বেতনও ভালো পাই। অনেক টাকা এনজিওতে দেনা ছিলাম। এখানে কাজ করেই শোধ করেছি, পাশাপাশি সংসারও চালাচ্ছি।' তিনি বলেন, পেঁয়াজ বীজ বপন করার সময় এসেছি, বীজ পরিচর্যা করছি, এরপর উত্তোলন করে মাড়াই করে প্রক্রিয়াজাত করে তারপর বাড়িতে যাব। শুধু আমি একাই নই, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার শ্রমিক মানুষ এ কাজ করতে এসেছে।'
পেঁয়াজ বীজ ক্ষেতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। নারী শ্রমিক শামেলা বেগম বলেন, 'পেঁয়াজ বীজের সময় কাজ করে থাকি। বিশেষ করে পরাগায়নের সময় ও উত্তোলন শেষে বীজ ধোয়ার কাজ করে থাকি। প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে স্বামীকে সাহায্য করি। আবার ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা এবং নিজের শখ পূরণের জন্যও এই টাকা কাজে লাগে।
তিনি আরো বলেন, 'অনেক সময় সংসারে অনেক কিছু কিনতে হয় যা স্বামীকে বলা যায় না, সেই সব জিনিসপত্র কিনে থাকি। বছরের আট মাস কাজ করতে পারি। সকলে একসঙ্গে কাজ করি, ভালোই লাগে। শুধু আমি না, এলাকার অনেক নারীই আমার সঙ্গে বীজ ক্ষেতে কাজ করে।'
মাঠে পেঁয়াজের বীজের সাদা ফুলের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছে দর্শনার্থীরা। শিক্ষার্থী শিরিন আক্তার বলেন, এ এক অন্যরকম অনুভূতি। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছি, অনেক মজা করেছি।'
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, দেশের চাহিদার অর্ধেক বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে এ জেলায়। এ বছর পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে এক হাজার ৮৫৪ হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৬৪ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। পেঁয়াজ বীজ চাষের জন্য ফরিদপুরের মাটি ও আবহাওয়া বেশ ভালো হওয়ায় ভালো ফলন পান চাষীরা।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাদুজ্জামান জানান, পেঁয়াজ বীজের চাহিদার অর্ধেক বীজই উৎপাদন হয় এ জেলায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বীজের ফলন ভালো হয়েছে। স্বর্ণের মত মূল্য হওয়ায় এ বীজকে ‘কালো সোনা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। চাষীরা এখন শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভালো ফলনের ক্ষেত্রে পরাগায়ন করা খুবই জরুরি। চাষীরা এখন পরাগায়নের কাজ করছে। অনেকেই কর্মসংস্থান পথ খুঁজে পেয়েছে উদ্যোক্তাদের কারণে।