News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/20F
জুমার নামাজ শেষে বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে কারখানাতে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফার্নিচার কর্মচারী হৃদয় হোসেন (১৮)। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) দুপুরে ঢাকার বাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় পরিবারের একমাত্র আদরের ছেলে হৃদয় হোসেন।
শহীদ হৃদয় মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামের শাহ আলম হাওলাদারের ছেলে। হৃদয়ের পরিবারে মা-বাবা ও এক বোন রয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮ বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কাঁধে আঘাত পান হৃদয়ের বাবা শাহ আলম হাওলাদার। এরপর থেকে ভারী কোনো কাজ করতে পারতেন না তিনি। এর মধ্যে আবার হার্টে সমস্যা দেখা দেয় তার। এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে নাছিমা বেগমের সংসারে তৈরি হয় আর্থিক সংকট। সংসারের হাল ধরতে সেলাইয়ের কাজ করতে বাধ্য হন স্ত্রী নাছিমা বেগম। পরে কোনো মতে চলতে থাকে সংসার। তখন একমাত্র ছেলে হৃদয় হোসেন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। সংসারের হাল ধরতে তাকে ঢাকায় একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজে পাঠিয়ে দেন দরিদ্র এই দম্পতি। ফার্নিচারের দোকানে প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করতো হৃদয়। বেতন যা পেত নিজের খরচ রেখে বাড়িতে বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতেন হৃদয়।
জানা গেছে, ঢাকার বাড্ডার লিংকরোড এলাকায় হৃদয়ের ফুপাতো ভাই মনির মোল্লার “হাসান স্টিল অ্যান্ড ফার্নিচার” এ কাজ করতো। ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজে আদায় করে মনির মোল্লার বোনের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে যান হৃদয়। পরে খাবার শেষ করে কারখানাতে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হতে গেলে টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সড়ক। এ সময় একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় হৃদয়ের শরীরে। পরে খবর পেয়ে ফার্নিচার দোকানের মালিক ফুপাতো ভাই মনির মোল্লা স্থানীয় এক হাসপাতালে গিয়ে হৃদয়কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে বনশ্রী এলাকার নাগরিক স্পেশালাইজড প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঐদিন রাতে গ্রামের বাড়ি শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীর চর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামে মরদেহ এসে পৌঁছালে শোকের মাতম ওঠে পরিবার জুড়ে। পরে হৃদয়কে ২০ জুলাই শনিবার কবরস্থানে দাফন করা হয় ।
হৃদয়ের ফুপাতো ভাই মনির মোল্লা বলেন, হৃদয় আমার দোকানে কাজ করতেন। দুপুরে খাবার খেয়ে কারখানায় ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বুকের এক পাশে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় তার। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভর্তি করতে চায়নি কোনো হাসপাতাল! চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল। হাসপাতালে চিকিৎসা পায়নি।
হৃদয়ের দাদা রফিক হাওলাদার জানান, পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলেন হৃদয় হোসেন। হৃদয়কে হারিয়ে বাবা শাহ আলম নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ছয় মাসেও তার কান্না থামেনি। হৃদয় হোসেনের পোশাক তার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবু হৃদয়ের একটা প্যান্ট হাতের কাছে পেয়ে তা জড়িয়ে বিলাপ করেন শাহ আলম, গভীর রাতেও ফুঁপিয়ে কাঁদেন।
তিনি আরও বলেন, শাহ আলমের মানসিক অবস্থা অস্বাভাবিক। তাই ড্রাইভারী চাকরিও তাকে ছাড়তে হয়েছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় চলছে তাদের পরিবার। অনেক নেতৃবৃন্দ বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কেউ কোন সহযোগিতা পাইনি। এরই মধ্যে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
শোকে বাকরুদ্ধ বাবা নিশ্চুপ শাহ আলম হাওলাদার। তিনি বলেন, আমার ছেলেতো কোনো আন্দোলন করে নাই ও দোকানে যাচ্ছিল। আমার ছেলের কি অপরাধ ছিল? ওরে কেন গুলি কইরা মারল? বাবা হয়ে সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়ার কষ্ট কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। সন্তানের মরদেহ কাঁধে নেব, তা কখনও ভাবিনি। কিন্তু কেন আমার সন্তান গুলিতে মারা গেল। তার কি কোনো বিচার পাব?
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয়ের মা নাছিমা আক্তার বলেন, আমাদের ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ছেলেকে আর ফিরে পাবো না। তবে আমরা চাই দেশটা যেন ভালো চলে। ছেলেকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশ যদি আগের মতো চলে তাহলে এতো লোক শহীদ হয়ে লাভ কী ! তাই আমরা সরকারের নিকট তা বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাচ্ছি।