News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/1WF
তিস্তার উজানের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে আসছে। ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশের লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১৭০ কিলোমিটার তিস্তা অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
তিস্তাকে বলা হয়ে থাকে উত্তর জনপদের জীবনরেখা। সেই তিস্তার বুকে ভারতীয় অংশে টইটম্বুর পানি থাকলেও একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এর বাংলাদেশ অংশ যেন এখন মরা খাল। ফলে অস্তিত্বসংকটে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, হুমকিতে পরিবেশ। আর এ নদীর জলরাশির ওপর জীবিকানির্ভর লাখ লাখ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন।
পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, অনৈতিক ঢিলেমি আর হঠকারিতায় তিস্তা তীরবর্তী ও এর আশপাশের প্রকৃতি এখন রুক্ষ। অন্যদিকে বর্ষায় ভারত বন্যা নিয়ন্ত্রণে গজলডোবার সব গেট খুলে দেয়। তখন মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ভাঙে বসতভিটা, বিলীন হয় ফসলি জমি। প্রতিবছর নিঃস্ব হতে থাকে হাজার হাজার পরিবার। ভারতের এই আচরণ আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিরও চরম লঙ্ঘন।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুরসহ আশপাশের ৪-৫ জেলার অনাবাদি জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাড়তি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্মিত হলেও সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে এটি উত্তরের মানুষের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯০ সালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের পিত্তিফাটা নামক স্থানে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ৬১৫ মিটার দীর্ঘ এ ব্যারাজে ৫২টি গেট রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪টি গেট তিস্তার মূলধারা প্রবাহের এবং বাকি ৮টি সেচ প্রকল্পের জন্য তৈরি করা হয়। সেচ প্রকল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সিলট্রাফ খনন করা হয়।
সূত্র জানায়, ব্যারাজের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ৫২ দশমিক ৪০ সেন। স্বাভাবিক সময়ে পানি প্রবাহ ২০ হাজার কিউসেক ধরা হলেও ৪ লাখ কিউসেক পর্যন্ত পানি ধারণক্ষমতা রয়েছে এ ব্যারাজের। তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগী মানুষরা বলছেন, যখন পানি চাই, তখন পাই না আর যখন পানির কোনো প্রয়োজন নেই, তখন পানিতে ভেসে বেড়াই- এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো জানালেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তা তীরের গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক মফিজ উদ্দিন। নদীপাড়ের জেলেরা জানান, এক সময় তিস্তায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। সেই মাছ বিক্রি করেই তারা সংসার চালাতেন। সে সময় তিস্তার মাছ ঘিরে লালমনিরহাট সদরের তিস্তা বন্দরে শুঁটকির আড়ত ছিল। এখন পানিশূন্য তিস্তায় মাছের আকাল পড়েছে। অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা রয়েছেন, তাদের সংসার চলে অনাহারে-অর্ধাহারে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা তাদের বাপ-দাদার পুরোনো পেশা ছেড়ে এখন দিনমজুর কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে হয়েছেন ছিন্নমূল। ছোট ছোট খেয়াখাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, তিস্তায় প্রয়োজনমতো পানি এলে দেশের উত্তরাঞ্চলের এক বৃহৎ অংশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো। নদীতে স্বাভাবিক পানি না থাকায় বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ, পাখিসহ নানা প্রাণী। সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা শুকিয়ে অনেকটা মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে জেগেছে মাইলের পর মাইল বালুচর। বালুচরে হেঁটে যোগাযোগ করার কারণে চরম কষ্টে পড়েছেন তিস্তাপাড়ে বসবাসকারী কয়েক লাখ মানুষ। কোথাও প্রায় ৯ মাইল, আবার কোথাও ১২ মাইল প্রশস্ত হয়েছে তিস্তার বুক। এখন শুধু ধু-ধু বালুচর। পানি না থাকায় চলাচল করতে পারছে না নৌকা। নৌকাঘাটগুলোও অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রী পারাপারের কাজে নিয়োজিত শত শত মাঝি এখন কর্মহীন। অনেকে এ পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
প্রতিবছরই পূর্ব তীরের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ২৬টি ইউনিয়নের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বর্ষাকালে বন্যা, পানিবন্দি ও নদীভাঙনের মোকাবিলা করে টিকে আছেন। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে নিত্য লড়াই করতে হচ্ছে মরুময়তার সঙ্গে। শুধু পূর্ব তীররক্ষা বাঁধ না থাকায় তিস্তা ব্যারাজের বৃহৎ সুফলের ছিটেফোঁটাও পাচ্ছেন না এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও কৃষক। তিস্তা ব্যারাজের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে লালমনিরহাটের গড্ডিমারী এলাকার কৃষক আক্কাস আলী বলেন, ‘শুকান (শুষ্ক মৌসুমে) দিনে পানি নাই। বৃষ্টির দিনে পানি দিয়ে হামাকে ডুবি থোয় (পানিবন্দি রাখে), এটা কোন নিয়ম বাহে?’ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধান গ্রামের কৃষক মনছুর আলী (৬৮) বলেন, নদীতে পানি নেই বললেই চলে। মাইলের পর মাইল শুধু ধু-ধু বালুচর। বালুচর দিয়ে যাতায়াত করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের । লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর এলাকার জেলে শহিদার রহমান (৬০) বলেন, নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলেরা পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। একই গ্রামের মাঝি শুকুর আলী (৫৮) বলেন, তিস্তায় পানি না থাকায় প্রায় সবগুলো নৌকাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। লোকজন হেঁটে তিস্তা পাড়ি দিচ্ছে। নৌকা চলাচল না করায় মাঝিরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।