News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/6o
পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। সরকার বৃক্ষরোপণ করতে উদ্বুদ্ধ করলেও খোদ বন বিভাগ গত এক বছরে শরীয়তপুরে এক হাজার ৭০০টি গাছ কেটেছে। তবে গত তিন বছরেও একটি গাছও রোপণ করেনি।
পদ্মা, মেঘনা বেষ্টিত শরীয়তপুর এক সময় সবুজ শ্যামল ছায়া সুনিবিড় একটি জেলা ছিল। কিন্তু প্রতি বছর কারণে-অকারণে গাছ কাটা হলেও নতুন করে গাছ রোপণ না করায় দেশের অন্যান্য জেলার মতো শরীয়তপুরেও চলছে তাপ প্রবাহ। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষসহ সব স্তরের জনজীবন।
সম্প্রতি শরীয়তপুরের বিভিন্ন সড়কে ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র তাপ প্রবাহের মধ্যেও কাটার জন্য নতুন করে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
জেলার বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরে শরীয়তপুরের ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন সড়কের ১৯ কিলোমিটার অংশে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৭০০টি গাছ টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছে বন বিভাগ। এর মধ্যে ভেদরগঞ্জ উপজেলার পুরাতন মোল্লার বাজার থেকে বাংলা বাজার পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, চরপায়াতলি থেকে হাকিম আলী ব্রিজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, সদর উপজেলার বাংলা বাজার (আমিন বাজার) থেকে ঘোড়ার ঘাট পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, আটং ডিসি রোড থেকে পম লাকার্তা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, ডামুড্যা উপজেলার স্বনির্ভর থেকে কুতুবপুর পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার, গোসাইরহাট উপজেলার দপ্তরি বাড়ি থেকে মলংচরা পর্যন্ত ১ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। এছাড়া আরো গাছ কাটার জন্য জেলার বিভিন্ন সড়কের গাছে চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটার কারণে এসব সড়কে এখন তীব্র রোদের তাপ প্রবাহ।
সড়কে চলাচলকারী পথচারীসহ সড়কের দুই পাশের মাঠে কৃষিকাজ, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ছে শ্রমিকরা। তীব্র এই গরমে কোথাও গাছের নিচে বসে একটু ঠান্ডা হওয়ার সুযোগও নেই তাদের। এভাবেই গত তিন অর্থ বছরে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জেলার সড়কগুলোর শতবর্ষী বিভিন্ন গাছসহ কয়েক হাজার গাছ কাটা হলেও একটি গাছও রোপণ করেনি বন বিভাগ। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে সর্বশেষ ২০২১ সালে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছিল বন বিভাগ থেকে।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর জেলা কৃষি নির্ভর একটি জেলা। এক সময় অধিকাংশ জমির চাষাবাদ খাল ও নদীর পানি থেকে হলেও প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে কৃষকরা সেচনির্ভর হয়ে পড়ছে। বর্তমানে জেলার কৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ১৮ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমি। এর মধ্যে চাষাবাদ যোগ্য ৮২ হাজার ২৭৬ হেক্টর জমি। চাষাবাদ যোগ্য এই জমির শতকরা ৪০ ভাগ সেচের ব্যবস্থা হয় খাল ও নদীর পানি থেকে। বাকি ৬০ ভাগ জমির চাষাবাদ গভীর নলকূপ থেকে সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে।
জেলা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ কৃষি জমির দুই পাশের সড়কে কোনো গাছ নেই। যেগুলো ছিল তা কেটে নিয়েছে বন বিভাগ। গ্রাম ও শহর অঞ্চলের বাজারগুলোতে গাছ নেই। গাছ কাটার ফলে এক সময়কার ছায়া সুনিবিড় শরীয়তপুর জেলা তপ্ত হয়ে উঠেছে। কৃষকরা গভীর নলকূপের সাহায্যে কৃষি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে। তপ্ত রোদের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও অনেক সড়কে কোনো গাছের একটু ছায়াও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন বাড়ি নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বন বিভাগের গাছ কর্তনের ফলেই এমন অবস্থা হয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
আবুল হোসেন বেপারীর বাড়ি ভেদরগঞ্জের মোল্লার হাট এলাকায়। জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, গাছের অপর নাম জীবন। ছোটবেলা থেকেই এমন কথা জেনে আসছি। কিন্তু বন বিভাগের কাজ গাছ রক্ষা করা হলেও তারা প্রতি বছর গাছ কেটেই চলেছেন কিন্তু রোপণ করছেন না। আমরাও বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছ কাটছি। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে ফেলার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না, গরম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বন বিভাগ ও আমাদের সবার উচিত আগে গাছের চারা রোপণ করা ও চারার জীবন নিশ্চিত করা, তারপর গাছ কাটা।
বাঁধন মাল পেশায় একজন কৃষক। তিনি বলেন, এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে। কিন্তু সড়কের দুই পাশে তাকিয়ে দেখুন কোনো গাছ নেই। সব গাছ কেটে উজাড় করে ফেলা হয়েছে। এই গরমে মাঠে ধান কাটতে যেতে সাহস হয় না। তবুও জীবিকার তাগিদে যেতে হবে। কিন্তু তপ্ত রোদের তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছের নিচে বসে একটু জিড়িয়ে নেওয়ার উপায় নেই। বৃষ্টি না হওয়ার ফলে গভীর নলকূপ থেকে পানি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে বাঁচা সম্ভব হবে না আর।
নূর মোহাম্মদ সরদার নামে গোসাইরহাটের আরেক কৃষক বলেন, আমার বয়স প্রায় ৭০ বছর। এ বছরের মতো জীবনেও এত গরম আমি দেখিনি। গাছ ছায়া দেয়, বাতাস দেয়। কিন্তু আমরা গাছ কাটি, বন বিভাগও গাছ কাটে। এভাবে গাছ কাটতে থাকলে তো গরম আরও তীব্র হবে। বন বিভাগ যে গাছ কেটেছে, সেই পরিমাণ গাছ রোপণ করার অনুরোধ করব।
ইলিয়াস হোসেনের বাড়ি ডামুড্যায়। মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। ৮ সদস্যর পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। সারাদেশে হিট এলার্ট চলছে জেনেও মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করতে এসেছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, যত গরম পড়ুক, কাজ না করলে বাড়িতে সবাই না খেয়ে থাকবে। টিভিতে নিয়মিত দেখি হিট এলার্ট জারি করা হয়েছে, বৃষ্টি হবে না। যদি সরকারের বন বিভাগ গাছ না কেটে গাছের চারা রোপণ করত তাহলে আমাদের গরমে হাঁসফাঁস করতে হতো না।
বন বিভাগের এমন গাছ কাটার বিষয়টি নিয়ে অ্যাডভোকেট মোদাচ্ছের হোসেন বাবুল বলেন, সারাদেশের সঙ্গে শরীয়তপুরের তাপমাত্রাও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বন বিভাগ গাছ রক্ষা করে যেখানে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে, সেখানে তারা বছরের পর বছর গাছ কেটেই যাচ্ছে। কিন্তু গাছের চারা রোপণের নাম গন্ধও দেখতে পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে জলবায়ু আরো পরিবর্তন হবে। প্রাণীকূল জীবন সঙ্কটে পড়বে। বন বিভাগ গাছ কাটলে নিয়ম অনুযায়ী গাছ রোপণ করার কথা। কিন্তু সেটা তারা না করে শরীয়তপুরের পরিবেশকে এভাবে অসহনীয় করে তুলেছে। বিষয়টি চিন্তার ও উদ্বেগজনক।
শরীয়তপুরের বন বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি অর্থ বছরে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় ১৯ কিলোমিটার সড়কের ১ হাজার ৭০০ গাছ কাটা হয়েছে। গাছের বয়স ১০ বছর হলেই আমরা গাছ কেটে ফেলি। সর্বশেষ ২০২১ সালে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে জেলায়। চুক্তি শর্ত অনুযায়ী আমরা আগামীতে বৃক্ষরোপণ করব।
বিষয়টি নিয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেই বিষয়টা দেখছি। নতুন করে গাছ লাগানোর ব্যাপারে আপাতত আমরা কাজ করছি, পরে জানাব।