News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/NQ
গতকাল সোমবার সাকাল ১১টা। রাজধানীর উত্তরার রাজউক কলেজের মোড়। গণভবন অভিমুখে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সেনাদের সামনে পড়ে হাজারো মানুষ। এ সময় অনামিকা নামের এক শিক্ষার্থী সেনা সদস্যদের অনুরোধ করেন, ‘আমাদের এই ন্যায্য দাবিকে আপনারা সমর্থন দিন, আমাদের যেতে দিন।
সেনা সদস্যরা বাধা হয়ে দাঁড়ালেন না। এগিয়ে চলল ‘মার্চ টু ঢাকা’ অভিযাত্রা। বিজয়ের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে গত ৩০ দিনের আন্দোলনের একটি খণ্ড চিত্র এটি।
কাঙ্ক্ষিত সেই এক দফা দাবি পূরণের সংবাদ সারা দেশের মানুষ জানতে পারে দুপুর ২টার একটু পরই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণভবন অভিমুখে যাত্রা ঘিরে উত্তেজনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আরো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।
বৈঠকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ও রূপরেখা প্রণয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘দেশে একটা ক্রান্তিকাল চলছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। আমরা সুন্দর আলোচনা করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দেশের সব কার্যক্রম চলবে।’
সব হত্যাকাণ্ড ও অন্যায়ের বিচার করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন।’ তিনি ছাত্র-ছাত্রীসহ দল-মত-নির্বিশেষে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগের পর দুপুর আড়াইটার দিকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। তাঁর সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন। ভারত থেকে তিনি ইউরোপের কোনো দেশে বা লন্ডন যেতে পারে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে। তবে শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছেন বলে খবর দিচ্ছে ভারতের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, শেখ হাসিনা ভারতে নয়, লন্ডনে আশ্রয় চেয়েছেন। তবে ভারতের দিল্লি হয়ে তিনি লন্ডন যাবেন। সোমবার রাতটা হয়তো দিল্লিতে থাকবেন। শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি, যে কারণে তাঁরা যুক্তরাজ্যে যেতে পারেন।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করে। বিকেল ৩টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করে। সেখানে হাজারো মানুষের বিজয় উল্লাস দেখা যায়। ব্যানার, প্ল্যাকার্ডে বাংলাদেশের পতাকা ও ‘২য় স্বাধীনতা দিবস ৫ আগস্ট ২০২৪’ লেখা নিয়ে তাদের আনন্দ করতে দেখা গেছে। জাতীয় সংসদ ভবনেও সাধারণ মানুষের প্রবেশ দেখা গেছে। সেখানে নানাভাবে বিজয় উদযাপন করেছে সাধারণ মানুষ।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষা নেয়নি। তিউনিশিয়া থেকে শিক্ষা নেয়নি। মিসরে কিভাবে হোসনি মোবারক জনরোষে উড়ে গেছেন, সেখান থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি। জনগণের সরকার না হলে এমন পরিণতি যে হবে, এটাই হওয়ার কথা ছিল।
গণ-অভ্যুত্থান কখনো ঠেকানো যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহজেই সমাধান করা যেত। ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। দিনের পর দিন ভোট চুরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই যে এত প্রাণহানি, এর জবাব দেবে কে? দেশে সুশাসনের মারাত্মক অভাব। তিনি সুশাসন দিতে পারেননি। যাঁকে জাতির পিতা বলা হয়, তাঁর পরিবারের সদস্যদের এত করুণ পরিণতি কেন হবে? তাঁর এমন পরিণতি আমাদের দেখতে হলো। এসব হয়েছে শেখ হাসিনার দম্ভ ও অহমিকার কারণে।’
এদিকে গতকাল বিকেল থেকে সারা দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলে বিএনপি থেকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। চলমান সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশের সব মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানান।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর প্রবেশদ্বারের চার দিক থেকেই সাধারণ ছাত্ররা প্রস্তুতি নিতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাবাড়ী, গাবতলী ও উত্তরার দিক থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুতে অহিংস হলেও সরকারদলীয় নেতাদের উসকানিতে প্রতিহত করতে নামে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে পুলিশসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বাধা ও বল প্রয়োগের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে সংঘাতময়। গতকাল এই আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয় আসা পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।