মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর FT‑7BGI যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর পুরো দেশ গভীর শোক ও ক্ষোভে মুহ্যমান। দুর্ঘটনায় ৩৩ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু ও দেড় শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় সরকারের ভূমিকা এবং প্রতিক্রিয়া দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত জানা গেছে, আহতদের মধ্যে ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, যাঁরা ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন। বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ভারত ও সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকার প্রাথমিক যোগাযোগ করেছে। যদিও এই উদ্যোগও শুরুতে স্বচ্ছতা ও সময়ানুযায়ী না হওয়ায় হতাহতদের স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।
হাইকোর্ট ইতোমধ্যে এই ঘটনায় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে এবং দুর্ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চেয়ে ৪৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছে। পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে ৫ কোটি এবং আহতদের ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের সম্ভাব্য নির্দেশনার ভিত্তি জানতে চাওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, শিক্ষাপরীক্ষার স্থগিতাদেশ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরও তীব্র হয়েছে। মধ্যরাতে ফেসবুকে ‘পরীক্ষা স্থগিত’-এর ঘোষণা আসা এবং সকাল পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি না থাকায় হাজারো পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসে। এই ঘটনায় মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির অভিঘাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বল সমন্বয় এবং তথ্য পরিবেশন নীতির ভঙ্গুরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। মাইলস্টোন শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন কলেজ-স্কুলে মানববন্ধন, ক্লাস বর্জন ও মৌন প্রতিবাদ হচ্ছে।
শুধু রাজধানীতেই নয়, সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষার্থী পাঁচ দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ
২. নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন
৩. নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের বিদেশে চিকিৎসা
৪. দোষীদের দ্রুত শাস্তি
৫. শিক্ষাক্ষেত্রে সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
এছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের ঘটনায় নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও বলপ্রয়োগ করেছে, যা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বয়হীনতার সমালোচনায় অধিকাংশই একমত। এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে মাসিক সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্য ও ছাত্রলীগের নামে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতা হারানো রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো এখন জন-আন্দোলনের পেছনে থেকে অরাজকতা উস্কে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।
সরকার জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যুদ্ধবিমানটির ‘কারিগরি ত্রুটি’ প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO) ও বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে। চীন থেকে আনা FT‑7BGI মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে এটাই প্রথম দুর্ঘটনা নয়—আগেও এই বিমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু সেগুলো নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত এই দুর্ঘটনাকে “জাতীয় শিশুবান্ধব নীতির পরিপন্থী” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার প্রতীক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা, অদক্ষ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং স্বচ্ছতার অভাব আজ জনমানুষের আস্থা ভেঙে দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ—এই শোককে যেন রাজনীতি বা চক্রান্তে পর্যবসিত হতে না দেওয়া হয়। প্রয়োজন দ্রুত বিচার, মানবিক সহায়তা, এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আন্তরিকতা ও দক্ষতা প্রদর্শন। তা না হলে এই ‘ট্র্যাজেডি’ পরিণত হবে একটি বৃহত্তর ‘জাতীয় আস্থাহীনতা’র সংকটে।