News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/2Pi
পশ্চিম এশিয়ায় ফের জ্বলছে যুদ্ধের আগুন। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক-সামরিক উত্তেজনা এখন পরিণত হয়েছে পূর্ণমাত্রায় সংঘাতে। একে কেন্দ্র করে শুধু দুটি দেশের নয়, জড়িয়ে পড়তে চলেছে বিশ্ব রাজনীতির বড় শক্তিগুলিও—বিশেষ করে আমেরিকা, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা।
এই উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সম্প্রতি তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকুক বা না থাকুক, ইরানের পরমাণু পরিকাঠামো ধ্বংস করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা আমাদের সুরক্ষা নিয়ে কোনও আপোস করব না। ইরান আমাদের অস্তিত্বের হুমকি, এবং তাদের পরমাণু ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করতেই হবে।”
এই ঘোষণার পরপরই শুরু হয় ইসরায়েলের ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। যার লক্ষ্য—ইরানের পরমাণুঘাঁটি ও সামরিক কমান্ড সেন্টার। এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ইরানের ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানী ও বেশ কয়েকজন শীর্ষ সেনাকর্তা।
আমেরিকার ভূমিকা এখন পর্যন্ত দ্বিধাজনক। হোয়াইট হাউস সূত্রে প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, “ইরানকে কূটনৈতিক পথে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা এখনও আছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী ১৪ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন—যুদ্ধের পথে হাঁটবেন, না আলোচনার।”
যদিও ইসরায়েল দাবি করেছে, হামলার আগে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের মধ্যে দীর্ঘ ফোনালাপ হয়েছিল। ফলে যুদ্ধের শুরুতে আমেরিকার মৌন সমর্থন ছিল বলেই ধারণা করছে আন্তর্জাতিক মহল।
ইরান চুপ করে থাকেনি। তারা ইসরায়েলের ওপর পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ১৯ জুন, যখন তেল আভিভের অজোর শহরতলিতে ইরানের ক্লাস্টার বোমা আঘাত হানে। এই প্রথমবার ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে এমন বিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার হল।
‘ক্লাস্টার বোমা’ এমন এক ধরনের অস্ত্র, যা একটি বড় ক্ষেপণাস্ত্রের ভিতর ছোট ছোট একাধিক বোমা বহন করে এবং শূন্যে ফেটে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেগুলি ছড়িয়ে দেয়। এই বোমাগুলি অনেক সময় সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত না-ও হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে এবং পরবর্তীতে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
রাডার সূত্রে জানা গিয়েছে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন তার ‘রহস্যময় বিমান’ ইরানের দিকে পাঠিয়েছে, যা জল্পনার জন্ম দিয়েছে—তেহরানকে বেজিং গোপনে সাহায্য করছে কি না, সেই প্রশ্নে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাত সামাল দিতে উদ্যোগী হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জেনেভায় ইরানের বিদেশমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিনিধিরা। আলোচনার লক্ষ্য—তেহরানকে যুদ্ধে না গিয়ে কূটনৈতিক পথে ফেরানো।
২০০৮ সালের ‘কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশন’ অনুসারে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ। ১১১টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও ইরান, ইসরায়েল ও আমেরিকা তাতে সম্মত হয়নি। একাধিক মানবাধিকার সংগঠন এই অস্ত্র ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করেছে। কারণ, যুদ্ধ শেষ হলেও এই বোমা থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বিপদের মুখে পড়তে পারেন।
নতুন গোয়েন্দাপ্রধান, নতুন কৌশল: ইরান রণনীতি বদলাচ্ছে?
ইসরায়েলের হামলায় গত সপ্তাহে প্রাণ হারান ইরানের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এবং আইআরজিসি-র তিন শীর্ষ সেনাকর্তা। তার পরেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গোপনীয়তা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজিদ খাদেমিকে দেশের নতুন গোয়েন্দা প্রধান করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয়, ইরান যুদ্ধের রণকৌশল পুনর্গঠনের পথে।
পশ্চিম এশিয়া আজ এক আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে। ছোট কোনও ভুল পদক্ষেপই ভয়ানক ফল আনতে পারে। ট্রাম্পের আগামী সিদ্ধান্ত, ইউরোপের কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং চীন-রাশিয়ার ভূমিকা—এই তিনটি ফ্যাক্টরই নির্ধারণ করবে, এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আসবে, না আরও বিস্ফোরণ ঘটাবে।
বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের চোখ এখন পশ্চিম এশিয়ার আকাশে। কারণ, একটিমাত্র ভুল ক্ষেপণাস্ত্র এই উত্তপ্ত অঞ্চলকে বিশ্বযুদ্ধের কিনারায় নিয়ে যেতে পারে।