মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা যেন আরেকবার ইতিহাসের পাতা নাড়িয়ে দিয়েছে। শুক্রবার ভোররাতে ইরানের ভেতরে একাধিক সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনায় ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। 'অপারেশন রাইজিং লায়ন' নামের এই অভিযানে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চপদস্থ সামরিক নেতাদের বাসভবন লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজ জানিয়েছে, রাজধানী তেহরানের কাছে ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনার কাছে দুটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ভূগর্ভে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে অবস্থিত এই সংবেদনশীল স্থাপনার কাছে বিস্ফোরণ ঘটায় আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এ হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামি রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি এবং আইআরজিসির বিমানবাহিনী কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহসহ অন্তত ২০ জন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। সব মিলিয়ে হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৮ জন এবং আহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ।
ইসরায়েলের শক্তি-প্রদর্শন: ২০০ যুদ্ধবিমান অংশ নেয়
ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে তারা ইরানের ১০০টির বেশি স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। লক্ষ্য ছিল—ইরানের ড্রোন অবকাঠামো, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা এবং পারমাণবিক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা।
সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামির বলেন, “আমরা পূর্ণ শক্তি এবং সর্বোচ্চ গতিতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়।”
ইরানের পাল্টা জবাব: ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা
হামলার জবাবে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান প্রায় ১০০টি ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র মাঝপথেই ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। তবুও, মধ্য ইসরায়েলের আবাসিক এলাকায় একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। এতে এখন পর্যন্ত তিনজন নিহত এবং ৭০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
সামরিক হামলার মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনাও চরমে
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, “প্রত্যেক নিহত নাগরিকের রক্তের হিসাব চুকানো হবে। এই অপরাধের জবাব ইতিহাস মনে রাখবে।”
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, তিনি এই হামলার বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন। ইরানকে তিনি ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন, যেটি পেরিয়ে যাওয়ার পরেই এই অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি।
আঞ্চলিক যুদ্ধের ছায়া: বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক বৃহৎ যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। বিশেষত, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননে সক্রিয় ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এবং হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে সীমান্তে গোলাবর্ষণও শুরু হয়েছে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি যুদ্ধ থামিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলনির্ভর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ব এখন এক অস্থির সময়ের মুখোমুখি। পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের সরাসরি সংঘর্ষ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা মানবজাতির ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন প্রশ্ন—এই আগুন নিভবে, নাকি আরও বড় বিস্ফোরণের দিকে এগোবে পৃথিবী?