News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/2N8
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি আলোচিত তত্ত্ব হলো ‘তিন শূন্য তত্ত্ব’। তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার অসফলতার দিক থেকে যেন সেই শূন্য তত্ত্বের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। গত ১০ মাসে শূন্য সংস্কার, শূন্য বিচার ও শূন্য নিরপেক্ষতা দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি প্রায় অসফল সরকার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। এটাই যেন অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র সাফল্য।
অবশ্য এই ১০ মাসে প্রধান উপদেষ্টা এবং তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৬০০ কোটিরও বেশি টাকার আয়কর মওকুফ হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে তাঁর সব মামলা। গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার কমেছে।
ড. ইউনূসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, রিক্রুটিং এজেন্সির লাইন্সেস। ১০ মাসে একজন সরকারপ্রধান ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে লাভবান হয়েছেন, তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। গত ১০ মাসে তিনি ১১ বার বিদেশ সফর করলেও বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম ভিসা দিচ্ছে না, ভিসা বন্ধ সৌদি আরবের, সংযুক্ত আরব আমিরাতের।
থাইল্যান্ডের ভিসাও এখন মিলছে না সহজে। ইউরোপের দরজাও বন্ধ। প্রধান উপদেষ্টার মতো অন্যরাও নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছেন। উপদেষ্টাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি-লুটপাটের কাহিনি নিয়ে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়। অথচ কারো বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির গুরুতর অভিযোগ। এসব অভিযোগ নিয়ে কোনো নিরপেক্ষ তদন্তের উদ্যোগ নেই সরকারের। নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং নতুন আঙ্গিকে চলছে লুটপাট। শেয়ারবাজার থেকে নিরীহ জনগণের ২৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এসবের তদন্ত নেই, বিচার নেই। অর্থ উপদেষ্টা যেন আইএমএফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। তাঁর কাজ দেশের অর্থনীতি ঠিক করা নয়, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ করা। উপদেষ্টাদের নানা বিতর্কিত কথাবার্তা ও কাজকর্মে মানুষ বিরক্ত।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সদস্য দেশের নাগরিক নন। এই বিদেশি নাগরিকরা জনগণের ভাগ্যবিধাতা হয়ে গেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নাগরিকত্ব নিয়েও বিতর্ক আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য তিনটি। একটি হলো জুলাই গণহত্যার বিচার, দ্বিতীয়টি হলো সংস্কার এবং তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। কিন্তু ১০ মাসে বিচারের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি আমরা লক্ষ করিনি। শেখ হাসিনাসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ পর্যন্ত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। বিচারের নামে হচ্ছে প্রহসন। শত শত আসামি বানিয়ে মামলার গুরুত্ব হালকা করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে নিরীহ মানুষকে, অথচ আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশজুড়ে বেশুমার মামলা বাণিজ্য চলছে। যে যার বিরুদ্ধে ইচ্ছা মামলা করছে। মামলার নামে চলছে ব্ল্যাকমেইলিং।
অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় এজেন্ডা হলো সংস্কার। অথচ সংস্কারও যেন এক প্রহসনে রূপ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ সংস্কার কমিশনই বিশেষ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য গঠিত হয়েছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কথাই ধরা যাক। এই সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে। ওই বিশেষ গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। যার ফলে বাস্তবতাবিবর্জিত এই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে এই অর্থ ও সময় অপচয় করা হলো কার স্বার্থে?
রাষ্ট্র সংস্কার এখন পক্ষপাতদুষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকার যেন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে; আরো নির্দিষ্ট করে বললে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) পৃষ্ঠপোষকতা দিতে রাষ্ট্র সংস্কার কৌশল সাজিয়েছে। সবাই জানে, সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার একমাত্র জাতীয় সংসদের। কিন্তু নতুন সংবিধান, গণপরিষদ ইত্যাদি বিতর্ক তুলে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। সংস্কারে জনগণের অরুচি তৈরি করা হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজেই বলেছিলেন, ছাত্ররা হলেন তাঁর নিয়োগকর্তা। গত ১০ মাসে তিনি শুধু নিয়োগকর্তার কথাই শুনেছেন। জনগণের প্রত্যাশার কথা শোনেননি। ফলে এই সরকার তার নিরপেক্ষতা খুইয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এনসিপির পৃষ্ঠপোষক সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এনসিপি যেভাবে চাইছে, সেভাবেই সব কিছু হচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কারও মুখ থুবড়ে পড়েছে। নারী সংস্কার নিয়ে এরই মধ্যে পুরো দেশকে বিভক্ত করা হয়েছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনো সংস্কারই দৃশ্যমান নয়। এসব সংস্কার দেশকে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থায় নিয়ে গেছে। সব কিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ‘সংস্কার’ সরকারের কালক্ষেপণ করার; নির্বাচন না করার একটি কৌশল।
এবার আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্টত কালক্ষেপণ করছে। অতীতে সব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করেছে। তারা এই সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারও করেছে। তাহলে বর্তমান সরকারের এত সময় লাগবে কেন? এর কারণ এখন সুস্পষ্ট। বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে নির্বাচন বিলম্বিত করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কথা রাখছেন না। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। পরে তিনি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, সংস্কার সম্পন্ন হলে জুলাই সনদ তৈরি হবে এবং জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্বাচন হবে। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে কোনোভাবেই তিন মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। অথচ ১০ মাস পেরিয়ে গেছে। এনসিপি যেন দল গোছাতে পারে, তারা যেন নির্বাচনের মাঠে বিশেষ সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এই কৌশল চলতেই থাকবে—এটা এখন সবাই বুঝে ফেলেছে। অন্যদিকে একতরফাভাবে এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা সংকট আরো গভীর করেছে।
শুধু এনসিপি ও জামায়াত ছাড়া কেউই প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণায় সন্তুষ্ট নয়। দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট করে তিনি কি একপেশে একটি নির্বাচন করতে চান?
গত ১০ মাসে দেশে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ বেড়েই চলছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ন্যূনতম উন্নতি হয়নি; বরং প্রতিদিন অবনতি ঘটছে। দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করা হবে। কিন্তু গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তিও বাতিল করেনি। ভারত উল্টো বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি বাতিল করেছে। স্থলপথে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করার নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে। সরকার দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে সফল হতে পারেনি। সব কিছুর দাম বেড়েই চলছে। নতুন বাজেট বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষায়ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে নতুন করে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা দেশে ঢুকেছে। ভারত প্রতিদিন পুশ ইন করছে। অথচ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, ঈদের পর রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। তারা ফিরে যায়নি। বরং করিডরের নামে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে করিডরের নানা নাম দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। ‘মানবিক করিডর’, ‘চ্যানেল’ কিংবা ‘ত্রাণপথ’—যে নামেই ডাকা হোক, এটা দেশের স্বার্থবিরোধী। তবু এ নিয়ে সরকার নানা কৌশল অব্যাহত রেখেছে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে করা হচ্ছে সব কিছু।
দেশে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ, শিল্প ধ্বংসসহ বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নিরাপত্তার অভাব, জ্বালানিসংকট, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা হত্যা মামলা অর্থনীতিকে রীতিমতো অচল করে দিয়েছে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হলো বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বেশির ভাগ বড় বড় শিল্প গ্রুপের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে তাদের দুদক দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের নামে কোটি টাকার বিনিয়োগ সম্মেলনের ফলাফল শূন্য।
উপদেষ্টারা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তায় আওয়ামী লীগকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা একবার বললেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পালিয়ে গেছেন। তাঁকে ইন্টারপোলের সাহায্যে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। আবার আবদুল হামিদ যখন দেশে ফিরলেন, তখন বলা হলো, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট নেই। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা শোনা যায় প্রায় সব উপদেষ্টার মুখে।
তবে আমরা এসব সংকটের মধ্যেও একটা আশার আলো দেখছি, আর তা হলো আগামীকাল শুক্রবার (১৩ জুন) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওয়ান টু ওয়ান একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আমরা আশা করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করাতে সক্ষম হবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের মানুষ যে ভালো নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য স্তব্ধ হয়ে আছে, একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে—এই বাস্তবতাগুলো ড. ইউনূস যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, তত দেশের জন্য মঙ্গল। দ্রুত দেশে একটি নির্বাচন দিয়ে একটি স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। সরকার অকার্যকর ও অচল হয়ে পড়ায় নির্বাচন নিয়ে এখন আর বিলম্ব করার সময় নেই। এখন প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস গুরুত্বপূর্ণ। যত দেরি হবে, তত সমস্যা বাড়তে থাকবে, দেশ অস্থিতিশীল হবে। এই অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফ্যাসিবাদ ফের পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে। আমরা কাউকে নিশ্চয়ই সে রকম একটি সুযোগ দিতে চাই না। আর সে কারণেই দেশবাসী প্রত্যাশা করে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে একটি সুখবর দেবেন, স্বস্তির বার্তা দেবেন। জাতি যেন এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পায়। আশা করি, সেই পথের সন্ধান পাওয়া যাবে এই বৈঠক থেকে।