চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুতে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে কয়েকটি যানবাহনের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে মাত্র দুই বছর বয়সী এক শিশু। শুক্রবার (৬ জুন) দুর্ঘটনার দায় এড়াতে না পেরে রেলপথ মন্ত্রণালয় চারজন রেলকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে এবং ঘটনা তদন্তে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে বোয়ালখালী অংশে সেতুর ওপর এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি যানবাহন সেতুর ওপর নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। ঠিক তখনই কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি সেতুর দিকে ধেয়ে আসে। ট্রেনটি যখন চলা শুরু করে, তখন সেতুর ওপর অন্তত পাঁচ-ছয়টি সিএনজি ও মোটরসাইকেল আটকে ছিল। এরই মধ্যে ট্রেন একটি সিএনজিকে পিষে দেয়, যেখানে ছিল এক দম্পতি ও তাদের একমাত্র সন্তান আয়েশা।
দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, হতবিহ্বল বাবা সাজ্জাদুর নূর কাঁধে মৃত শিশু আয়েশাকে নিয়ে বিলাপ করছেন, আর পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা জুবাইদা ফেরদৌস ইসরা। তারা বোয়ালখালী থেকে চট্টগ্রামে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছিলেন।
কার্যত ‘মানবিক সংকেত’ উপেক্ষিত, তদন্তে উঠে আসছে গাফিলতির ইঙ্গিত। রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চালানোর আগে লাইনম্যান বা গেটকিপারদের কাছ থেকে সঠিক সংকেত নেওয়া আবশ্যক। প্রত্যক্ষদর্শী ও রেলসূত্রে জানা গেছে, ট্রেন চালক সেই নিয়ম অনুসরণ করেননি। ফলে সেতুর ওপর থাকা যানবাহনগুলোর জন্য কোনো নিরাপদ সরে যাওয়ার সুযোগ না রেখেই ট্রেনটি চলা শুরু করে, যার ফলাফল হলো ভয়াবহ প্রাণহানি।
রেলপথ মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে চারজন রেলকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সাময়িক বরখাস্তকৃতরা হলেন- গার্ড সোহেল রানা (চট্টগ্রাম হেড কোয়ার্টার), লোকোমাস্টার গোলাম রসুল, সহকারী লোকোমাস্টার আমিন উল্লাহ, অস্থায়ী গেটকিপার মাহবুব (টিএলআর),
একইসঙ্গে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও)। অন্য সদস্যরা হলেন ডিএমই (লোকো), ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার-১ এবং বিভাগীয় চিকিৎসক (পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম)। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কালুরঘাট সেতু বহু পুরোনো ও একপথের সংযোগ সেতু হওয়ায় এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই সেতুতে ট্রেন ও যানবাহন উভয়ের চলাচল নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেক সময় তা হয় না। সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রায়শই ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
একটি শিশুর মৃত্যু কখনোই কেবল সংখ্যায় গণ্য হওয়া উচিত নয়। এটি আমাদের রেলপথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ প্রতিফলন। তদন্ত কমিটির কাজ শুধু দোষীদের শনাক্ত করাই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশ করাও হওয়া উচিত। না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে, আর মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।