News Link: https://dailylalsobujbd.com/news/2M9
অনলাইন মিডিয়ার ব্যাপ্তির কারণে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেইক আইডি খুলে আপত্তিকর ছবি শেয়ার করা অথবা কারো নামে গুজব রটানো নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় দাড়িয়েছে। বেশ কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও অনলাইনে ফাঁস করেছে সাইবার অপরাধীরা। এছাড়া জিমেইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি হ্যাক করে চাঁদা দাবির ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এ সাইবার অপরাধ হল এমন এক অপরাধ যা কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সম্পাদিত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপকে বর্ণনা করে যা ব্যক্তি বা সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।
কিভাবে সাইবার অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করে এ নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, হ্যাকাররা প্রায়শই তথ্য চুরি করার জন্য একসাথে একাধিক কৌশল ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে ফিশিং, নকল ওয়াপ (ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস পয়েন্ট), ওয়াটারহোল আক্রমণ, ব্রুট ফোর্সিং, টোপ এবং সুইচ এবং ক্লিকজ্যাকিং। এর মাধ্যমে তারা কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে বা ডেটা মুছে ফেলতে বা চুরি করতে বা তাদের কাজ বন্ধ করতে এসব ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে আক্রমণ করে। মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) জানিয়েছে, অনলাইনে বিনা মূল্যে যেকোনো ফরম্যাটের ফাইল কনভার্ট করে দেওয়ার প্রলোভনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যাংকিং তথ্য, পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য সাইবার হামলাকারীরা হাতিয়ে নিচ্ছে। সিভি বা প্রোফাইলের জন্য এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট তৈরি, অত্যাধুনিক রিমোট অ্যাক্সেস টুলস এবং নিরাপত্তা এড়ানোর কৌশলের মতো আরও নানান উন্নত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে তারা তথ্য হাতাচ্ছে। এছাড়া নারীদের পরিচয় বেশেও সাইবার হামলাকারীরা প্রতারনা করছে।
কী কী সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয় তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনেক ধরণের সাইবার অপরাধই আলোচনার যোগ্য যার মধ্যে রয়েছে প্রতারণামূলক ইমেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো, অন্যের নামে ফেইক আইডি তৈরি থেকে শুরু করে ফিশিং স্ক্যাম এবং র্যানসমওয়্যার আক্রমণ। এছাড়া অন্যান্য সাইবার অপরাধগুরোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং জালিয়াতি, ই-কমার্স জালিয়াতি, সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি, তথ্য লঙ্ঘন, ডিডোএস আক্রমণ, সফটওয়্যার পাইরেসি, অনলাইন হয়রানি, পরিচয় জালিয়াতি, আর্থিক বা কার্ড পেমেন্ট ডেটা চুরি, কর্পোরেট ডেটা চুরি এবং বিক্রয়, সাইবার চাঁদাবাজি, ক্রিপ্টোজ্যাকিং, অবৈধ জুয়া, অনলাইনে অবৈধ জিনিসপত্র বিক্রি করা, শিশু পর্নোগ্রাফির জন্য আবেদন করা, উৎপাদন করা বা ধারণ করা।
কারা কারা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছে এ বিষয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) একটি গবেষণা করে। তাদের মতে, ভুক্তভোগীদের ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে। এছাড়াও আক্রান্তদের প্রায় ৫৯ শতাংশই নারী। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, যা মোট অপরাধের ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এছাড়া একশনএইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে ৫১৪ জন অনলাইন ব্যবহারকারীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারীই অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায় ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্যের সহজলভ্যতা, ব্যবহারকারীর অজ্ঞতা এবং প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে আইনি পদক্ষেপের ফাঁকের কারণে দেশে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। এ সম্পর্কে সাইবার ট্রাইব্যুনাল, ঢাকার বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত বলেন, সাইবার পরিসরে বেশির ভাগ নারী প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার অভাবে ভুক্তভোগী হন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সাইবার অপরাধের মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬৩,২৪,৯১,৬০৯ টাকা (তেষট্টি কোটি চব্বিশ লক্ষ একানব্বই হাজার ছয়শত নয় টাকা) ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা হয় যা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত ছিল।
সাইবার অপরাধ কারা করছে এবং কেন করছে এ বিষয়ে গবেষণায় দেখা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের অনেকেই সাইবার অপরাধ বা হ্যাকিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর মাধ্যমে তারা অর্থ উপার্জন করতে চায়। তবে, মাঝে মাঝে এসব অপরাধীদের উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন অপেক্ষা কারো কম্পিউটার বা নেটওয়ার্কের ক্ষতি করার লক্ষ্য রাখে। এগুলো রাজনৈতিক বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে হতে পারে।
সাইবার অপরাধের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ২০২৩ সালের গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্টে সাইবার অপরাধকে আজ এবং আগামী ১০ বছরের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ১০টি অপরাধ ঝুঁকির মধ্যে একটি হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। যদি সাইবার অপরাধকে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সাইবার অপরাধে ক্ষতির পরিমাণ হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, যার পরিমাণ ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
বাংলাদেশের আইনে পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯ এ কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কারো মানহানি করিলে তা সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বলে উল্লেখ আছে। এর বাইরে সরকার সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বেশ কয়েকটি আইন প্রনয়ণ করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে যে ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসে, এই আইনের অধীনে ৪০৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং ৩৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর সরকার ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন , ২০২৩ প্রণয়ন করে যা ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্থলাভিষিক্ত। এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারার বেশিরভাগ বিধান রাখা হয়েছে৷ এছাড়া এতে ভুয়া মামলা দায়েরকারীদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল। ২০২৫ সালের ২২ মে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল করে এবং সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রনয়ণ করে। এর মাধ্যমে সাইবার স্পেসে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন ও উক্ত অপরাধ বিচার করা হবে।
সাইবার অপরাধ থেকে বাঁচতে হলে নিজেকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় সেখানে ব্যক্তিগত গোপন তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট ব্যবহারে 'দেখা মাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়'- এই চর্চা অব্যাহত রাখা, সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে একাধিক সিম কার্ড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং টিকটক, ইমোসহ অন্যান্য অ্যাপগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারি সুনিশ্চিত করা এবং সুরক্ষা লঙ্ঘন হলে তা শনাক্তে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যহারের সময় প্রাইভেসি এবং সিকিউরিটি অপশন চালু রাখতে হবে। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের সময় পিন কোড কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। অপরিচিত কারো সাথে ভিডিও কলে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেহেতু নিরাপত্তা গবেষক, নীতিগত হ্যাকার এবং অপরাধী সবাই বেশিরভাগ হ্যাকিং টুল ব্যবহার করে, সেহেতু যদি টুলটি আপনার সিস্টেমে কোনও দুর্বলতা খুঁজে পায়, তাহলে তা হয় ঠিক করে কাজে লাগানো যেতে পারে। এছাড়া আপনার সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবহার করা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য একটি বিশ্বস্ত ও ভালো কোম্পানি নির্বাচন করা অপরিহার্য।
এরপরও সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে গেলে তিনটি উপায়ে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। প্রথমত সংশ্লিষ্ট থানায় আপনার অভিযোগ উল্লেখপূর্বক তথ্য প্রমাণ দাখিল সাপেক্ষে জিডি করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আলামতের স্ক্রীনশট, লিংক, অডিও/ভিডিও ফাইল অথবা রিলেটেড ডকুমেন্টস দাখিল করতে হবে। স্ক্রীনশট সংগ্রহের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন Address Bar এর URL টি দৃশ্যমান হয়। দ্বিতীয়ত cyber@police.gov.bd তে অথবা cyberhelp@dmp.gov.bd এই দুইটি ঠিকানায় মেইল করা যাবে। তৃতীয়ত জিডির কপি নিয়ে সরাসরি ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম ডিভিশনের Cyber Crime Unit অফিসে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সাথে দেখা করে ব্যবস্হা নেয়ার অনুরোধ জানানো যেতে পারে।
(এই লেখাটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব মতামত। এতে ব্যবহৃত সকল তথ্য লেখকের দ্বারা সংযোজিত, এবং কোনো তথ্য বিভ্রাট ঘটলে সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ তার জন্য দায়ী নয়।)