ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার রাতে ভারতের পরিচালিত অপারেশন সিঁদুর-এর আওতায় পাকিস্তানের নয়টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে বলে দিল্লি জানিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান একে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ইসরায়েলের নির্মিত ২৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত এবং ভারত পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহতের দাবি করেছে। একই সঙ্গে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সংঘাত বাড়ছে।

ভারত বলছে, গত মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, হামলায় অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। যদিও ভারত বলছে, তাদের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা, তবে ইসলামাবাদ পাল্টা হামলার ইঙ্গিত দিয়েছে। এতে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাত কতটা দীর্ঘায়িত হতে পারে, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

যুদ্ধ কি নতুন বাস্তবতা?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত নতুন কিছু নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের অভিযান ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের অভিযানের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী। বিশেষ করে, পাকিস্তানের জনবহুল পাঞ্জাব অঞ্চলে চারটি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় বাহিনী কোনও সামরিক অভিযান চালায়নি।

বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের চলমান প্রবণতা এই উত্তেজনাকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। চ্যাথাম হাউজ থিঙ্ক ট্যাংকের বিশ্লেষক সামির পুরি বলেন, গত তিন বছরে যুদ্ধ-নিবারণ ধারণাটি ধূলিসাৎ হয়েছে। এটি এখন নিত্যদিনের বাস্তবতা। বিশ্বজুড়ে আক্রমণাত্মক নীতির পরিসর ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের গাজা অভিযানের কারণে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়েছে। ইরান ২০২৪ সালে দুই দফা জটিল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে মার্কিন বাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি উত্তর কোরিয়াও রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেনে সেনা পাঠিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যখন সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। কারণ, দুটি দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে—প্রত্যেকের প্রায় ১৭০টি করে ওয়ারহেড রয়েছে। ভারতের ১২.৩ লাখ সক্রিয় সেনা এবং ৫০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের ৫ লাখ ৬০ হাজার সেনা এবং ৪০০টির বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে।

সংঘাতের নতুন রূপ

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ তীব্রতর হচ্ছে। উভয় পক্ষ থেকেই গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভারত জানিয়েছে, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে তাদের অংশে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তানও নিহতের কথা জানিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক প্রতিক্রিয়া এখন আগের তুলনায় অনেক কম নিয়ন্ত্রিত। ইয়েমেনের হুথিদের একটি রকেট ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছে পড়লে, ইসরায়েল পাল্টা হামলায় সানা বিমানবন্দরে ৫০ কোটি ডলারের ক্ষতি করে, ছয়টি বিমান ধ্বংস করে এবং টার্মিনাল ভবন গুঁড়িয়ে দেয়।

অপরদিকে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৭ জন স্কুলে আশ্রয় নেওয়া শিশু ও নারী। আগে যুদ্ধের সময় ‘অনুপাতগত প্রতিক্রিয়া’ বা বেসামরিক হতাহতের সীমা নির্ধারণের চেষ্টা করা হতো, কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে তা কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র কি নিষ্ক্রিয়?

বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংঘাতের খবর শুনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ওরা অনেকদিন ধরে লড়াই করছে।’ তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি এটিকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখছেন।

পূর্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান মার্কিন মিত্র ছিল। তবে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানকে ওয়াশিংটনের কৌশলগত পরিমণ্ডলে প্রায় উপেক্ষিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

সামির পুরি মনে করেন, ‘ভারত সম্ভবত মনে করছে যে তাদের পদক্ষেপ নিয়ে ওয়াশিংটন কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। এমনকি যদি কিছু বলে, সেটি কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া হবে, আন্তরিক নয়। এতে করে ভারত আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহিত হতে পারে।’

একটি অশান্ত বিশ্বব্যবস্থা

বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০তম বার্ষিকী পালিত হবে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী সংঘাতের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে বলে মনে হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৪৫ সালের পর ‘যুদ্ধ নিষিদ্ধ’ ধারণাটি এখন কার্যত বিলুপ্ত হতে বসেছে। যুদ্ধ এখন আর কেবল জরুরি প্রতিরক্ষা কৌশল নয়, বরং অনেক দেশের জন্য এটি একটি সহজাত নীতি হয়ে উঠেছে।

বিশ্ব এখন একটি অস্থিতিশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত এই বৈশ্বিক বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের এই উত্তেজনা কতদূর গড়াবে, তা নির্ভর করছে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। তবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।